নির্বাচন নিয়ে সাত মাসে ১৪ ধরণের বক্তব্য ইউনূসের। নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা!

নির্বাচন কবে অনুষ্ঠিত হবে—এ নিয়ে এখনো কোনো নিশ্চিত বার্তা পাওয়া যায়নি। ড. ইউনূসের বিবৃতি একদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর উপর দায় চাপালেও, অন্যদিকে সংস্কার না হলে নির্বাচন সম্ভব নয়—এমন বার্তা দিয়ে আবার নিজেই সীমা নির্ধারণ করে ফেলেন। ফলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠছে। ফলে বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। 

Editor
9 Min Read

বাংলাদেশের জনগণ তো বটেই, সারা বিশ্বের গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর মধ্যেও এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে—বাংলাদেশে কি খুব শীঘ্রই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে? True Gazette নির্বাচন কবে অনুষ্ঠিত হতে পারে, তা নিয়ে অধ্যাপক ইউনূসের বিভিন্ন সময়ে দেওয়া নির্বাচন নিয়ে বক্তব্য বিশ্লেষণ করেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর ৮ মাসে, ইউনূস নির্বাচন নিয়ে অন্তত ১৪ রকম বক্তব্য দিয়েছেন, যার ফলে নির্বাচন ঘিরে অনিশ্চয়তা আরও বেড়েছে। তার এসব বক্তব্য পর্যালোচনা করে ট্রু গেজেট আশঙ্কা করছে, দেশে সহসা কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। 

ইউনূসের বক্তব্যগুলো বিশ্লেষণ করে ট্রু গেজেট একটি প্যাটার্ন খুঁজে পেয়েছে। বিদেশি সংবাদমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় ইউনূস সাধারণত দ্রুত নির্বাচনের আশ্বাস দেন, অথচ বাংলাদেশি সংবাদমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় তার বক্তব্যে অস্পষ্টতা লক্ষ্য করা যায়। কখনো তিনি সিদ্ধান্তের ভার দেন দেশের রাজনৈতিক শক্তির ওপর, কখনো বলেন, জনগণই সিদ্ধান্ত নেবে। আবার কখনো মত পাল্টে বলেন, সংস্কার ছাড়া কোনো নির্বাচন হবে না।

আসুন জেনে নেই দেশের বিভিন্ন সময়ে নির্বাচন নিয়ে ইউনূস কি কি  আশ্বাস দিয়েছেনঃ

২৫ আগস্ট, ২০২৫– দায়িত্ব নেওয়ার দুই মাসের মধ্যে ভাষণে নির্বাচন   নিয়ে কথা বলেন তিনি।

অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, একটা বিষয়ে সবাই জানতে আগ্রহী, কখন আমাদের সরকার বিদায় নেবে। এটার জবাব আপনাদের হাতে, কখন আপনারা আমাদেরকে বিদায় দেবেন। আমরা কেউ দেশ শাসনের মানুষ নই। আমাদের নিজ নিজ পেশায় আমরা আনন্দ পাই।  আমাদের উপদেষ্টামণ্ডলীও এই লক্ষ্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে সবাই মিলে একটা টিম হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, কখন নির্বাচন হবে সেটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, আমাদের সিদ্ধান্ত নয়। দেশবাসীকে ঠিক করতে হবে আপনারা কখন আমাদের ছেড়ে দেবেন। আমরা ছাত্রদের আহ্বানে এসেছি। তারা আমাদের প্রাথমিক নিয়োগকর্তা। দেশের আপামর জনসাধারণ আমাদের নিয়োগ সমর্থন করেছে। আমরা ক্রমাগতভাবে সবাইকে বিষয়টি স্মরণ করিয়ে যাবো যাতে হঠাৎ করে এই প্রশ্ন উত্থাপিত না হয়— আমরা কখন যাব। তারা যখন বলবে আমরা চলে যাব।ড. ইউনূস বলেন, আমরা সংস্কারের অংশ হিসেবে নির্বাচন কমিশনকেও সংস্কার করব। কমিশনকে যে কোনো সময় আদর্শ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত রাখব।

৩০ সেপ্টেম্বর,২০২৪ঃ বাংলাদেশে দ্রুত সংস্কার শেষে নির্বাচন আয়োজনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। নিউইয়র্কে জাপানি সম্প্রচারমাধ্যম এনএইচকেকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এই অবস্থান জানান। 

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে গিয়েছিলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সেখানেই তিনি এনএইচকেকে সাক্ষাৎকার দেন। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ হচ্ছে যত দ্রুত সম্ভব সংস্কার করা এবং সরকার প্রস্তুত হলেই নির্বাচনের আয়োজন করবে।’ তিনি বলেন, ‘ব্যর্থতা এমন কিছু নয় যে, তা আমরা মেনে নিতে পারব না।’ 

১ অক্টোবর ২০২৪: জাতিসংঘে সাধারণ পরিষদের ভাষণ শেষে নিউইয়র্কে ভয়েস অব আমেরিকা বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ বা আগামী নির্বাচন কবে হবে, এ ব্যাপারে উপদেষ্টা পরিষদে আলোচনা হলেও এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। তিনি উল্লেখ করেন, “সরকার কখন মেয়াদ ঠিক করবে সেটা সরকারকে বলতে হবে। সরকার না বলা পর্যন্ত সেটা তো সরকারের মেয়াদ হচ্ছে না।” ​

১ অক্টোবর ২০২৪: জাতিসংঘ অধিবেশনের ফাঁকে মার্কিন পাবলিক ব্রডকাস্টিং সংস্থা এনপিআরকে দেওয়া ড. ইউনূস নির্বাচন কবে হবে এমন প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস বলেন, ‘কেউ কেউ বলছে, যত দ্রুত সম্ভব সংস্কার করার জন্য, না হয় আপনি (ড. ইউনূস) যত দেরি করবেন, তত অজনপ্রিয় হয়ে পড়বেন; সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যাবে। আবার কেউ কেউ বলছে, না, আপনাকে অবশ্যই এই সংস্কার শেষ করতে হবে। তাই আপনাকে এই দীর্ঘ সময় থাকতে হবে। কারণ, সবকিছুর সংস্কার না করে আমরা বাংলাদেশ ২.০-তে যেতে চাই না। তাই এই বিতর্ক চলছে।’ 

 ১৪ নভেম্বর ২০২৪: আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে কপ ২৯ সম্মেলনের ফাঁকে বার্তা সংস্থা এএফপিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস বলেন, “জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে হবে তা নির্ভর করছে সংস্কারের গতির ওপর। আমরা দ্রুত নির্বাচন দিতে চাই।” তিনি আরও বলেন, “সরকারে দায়িত্ব নেওয়ার পর আমরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম দেশকে ভোটের জন্য প্রস্তুত করতে। প্রস্তুতি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নির্বাচন দেওয়া হবে।

১২ নভেম্বর,২০২৪ঃ  সম্প্রতি আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনের (কপ২৯) ফাঁকে আল–জাজিরাকে সাক্ষাৎকার দেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস।বাংলাদেশে আগামী নির্বাচনের সঠিক সময় কখন হবে, সে বিষয়ে ড. ইউনূসের কোনো ভাবনা আছে কি না, সে প্রশ্নের জবাবে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘না। আমার মাথায় এমন কিছু নেই।’তিনি আরও বলেন, ‘যদি রাজনৈতিক দলগুলো চায় এটা (সংস্কার) ভুলে যাও, নির্বাচন দাও। তাহলে সেটা করা হবে।’

এক প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস বলেন, সাধারণত নিয়মিত সরকারের মেয়াদ পাঁচ বছর। মানুষ সরকারের মেয়াদ কম চায়। সংবিধানে নতুন করে চার বছরের প্রস্তাব করা হচ্ছে। সুতরাং এটা চার বছর বা তারও কম হতে পারে। এটা পুরোটা নির্ভর করছে মানুষ কী চায়, রাজনৈতিক দলগুলো কী চায় তার ওপরে।

 ২০ নভেম্বর ২০২৪: ডেইলি স্টারে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস বলেন, সংস্কার যত দ্রুত হবে, নির্বাচনও তত দ্রুত হবে। আর যদি রাজনৈতিক দলগুলো বলে যে তারা সংস্কার চায় না, তাহলে এখনই নির্বাচন দিয়ে দেবো।” তিনি আরও উল্লেখ করেন, “সংস্কার ও নির্বাচন সম্পূর্ণই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্যের বিষয়।” ​ “

১৬ ডিসেম্বর ২০২৪: বিজয় দিবসে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ড. ইউনূস বলেন, “মোটাদাগে বলা যায়, ২০২৫ সালের শেষ দিক থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করা যায়।” তিনি আরও উল্লেখ করেন, “আমি সকল প্রধান সংস্কারগুলি সম্পন্ন করে নির্বাচন আয়োজন করার ব্যাপারে বারবার আপনাদের কাছে আবেদন জানিয়ে এসেছি।” 

২৭ ডিসেম্বর ২০২৪: রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ আয়োজিত ‘ঐক্য, সংস্কার ও নির্বাচন’ শীর্ষক জাতীয় সংলাপে ভিডিও বার্তায় ড. ইউনূস বলেন, “সংস্কারবিহীন নির্বাচন বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে পারবে না।” তিনি আরও বলেন, “গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশের রূপান্তর পর্বে প্রবেশ করার অধিকার অর্জন করেছি।”

৩ মার্চ,২০২৫ঃ  বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে  তিনি জানান, অন্তর্বর্তী সরকার ২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের মার্চের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করতে চায়। তবে প্রয়োজনীয় সংস্কার দ্রুত সম্পন্ন করা গেলে নির্বাচন ডিসেম্বরেই হতে পারে, না হলে আরও কয়েক মাস লাগতে পারে।

১৪ মার্চ ২০২৫ঃ প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশে সংস্কারপ্রক্রিয়া সম্পর্কে জাতিসংঘের মহাসচিবকে অবহিত করেন। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত ছয়টি সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের বিষয়ে ইতিমধ্যে প্রায় ১০টি রাজনৈতিক দল তাদের মতামত জমা দিয়েছে। তিনি বলেন, দলগুলো ছয়টি কমিশনের সুপারিশগুলোর সঙ্গে একবার একমত হলে, তারা জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে; যা দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের পাশাপাশি রাজনৈতিক, বিচারিক, নির্বাচনসংক্রান্ত, প্রশাসনিক, দুর্নীতি দমন ও পুলিশ সংস্কারের একটি রূপরেখা হবে।

অধ্যাপক ইউনূস বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো যদি ‘সংক্ষিপ্ত সংস্কার প্যাকেজ’ নিয়ে একমত হয়, তবে নির্বাচন ডিসেম্বরেই হতে পারে। তবে,  তারা যদি ‘বৃহৎ সংস্কার প্যাকেজ’ গ্রহণ করে, তাহলে নির্বাচন আগামী বছরের জুনে অনুষ্ঠিত হবে। প্রধান উপদেষ্টা ‘সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন’ নিশ্চিত করার ব্যাপারে অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন।

মার্চ ১৭, ২০২৫ঃ  পুলিশদের সমাবেশে উপস্থিত হয়ে  অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হাতে খুব বেশি সময় নেই। আমরা ইতোমধ্যে সাত মাস পার করে এসছি। আমরা বলছি, ডিসেম্বরে নির্বাচন হবে। কাজেই কি কি সংস্কার করতে চাই করে ফেলতে হবে।’

০৪ এপ্রিল ২০২৫ঃ বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন যত দ্রুত সম্ভব আয়োজন করাই বর্তমান সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।শুক্রবার (৪ এপ্রিল) থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে ষষ্ঠ বিমসটেক সম্মেলনে বক্তব্যকালে তিনি এসব কথা বলেন।তিনি বলেন, আমি আমাদের জনগণকে আশ্বস্ত করেছি- এবার আমাদের দায়িত্ব সম্পন্ন হলে এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার কার্যকর হলে, আমরা একটি মুক্ত, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন করবো।প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বর্তমান সরকার দেশের প্রতিটি নাগরিকের সংবিধানগত অধিকার নিশ্চিত এবং সমুন্নত রাখতে, বিশেষ করে নারী, জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার সংরক্ষণের ক্ষেত্রে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

বিদেশি ও দেশি মিডিয়ার জন্য ভিন্ন বার্তা

ড. ইউনূসের বক্তব্য বিশ্লেষণ করে ট্রু গেজেট একটি নির্দিষ্ট প্যাটার্নও চিহ্নিত করেছে।

🔹 বিদেশি মিডিয়ায় (যেমন: আল জাজিরা, BBC, The Guardian) সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় তিনি প্রায়ই দ্রুত নির্বাচনের আশ্বাস দেন।

🔹 অন্যদিকে, বাংলাদেশি সংবাদমাধ্যমে কথা বলার সময় তার ভাষা হয় অনিশ্চয়তা ও দ্বিধান্বিততায় ভরা। কখনো বলেন “রাজনৈতিক দলগুলো সিদ্ধান্ত নেবে”, কখনো বলেন “জনগণ চাইলে নির্বাচন হবে”, আবার কখনো সরাসরি বলেন “সংস্কার ছাড়া নির্বাচন হবে না”

নির্বাচন কবে অনুষ্ঠিত হবে—এ নিয়ে এখনো কোনো নিশ্চিত বার্তা পাওয়া যায়নি ইউনূসের অন্তবর্তীকালিন সরকার থেকে। ড. ইউনূসের বিবৃতি একদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর উপর দায় চাপালেও, অন্যদিকে সংস্কার না হলে নির্বাচন সম্ভব নয়—এমন বার্তা দিয়ে আবার নিজেই সীমা নির্ধারণ করে ফেলেন। ফলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠছে। ফলে বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। 

error: Content is protected !!