৫ই আগস্ট বেলা ১২টার দিকে সেনাপ্রধান ‘জাতির উদ্দেশ্যে বক্তব্য’ দিবেন ঘোষনাতেই সবার ধারনা হয়ে যায় যে পট পরিবর্তন হতে যাচ্ছে এবং পরবর্তীতে তা-ই হয়।বক্তব্য নয়, বক্তব্য দেওয়ার ঘোষণার পরপরই এরপরে সারাদেশে শুরু হয় চরম নৈরাজ্য। দেশব্যাপী চলতে থাকে হামলা, খুন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের বিভীষিকা। এতে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে অসংখ্য সরকারী অফিস ও স্থাপনা। প্রায় ৫০০ থানা-ফাঁড়ি পুলিশ বক্স ও পুলিশ লাইন্সে হয় হামলা, অগ্নিসংযোগ ও অস্ত্রগার লুট। হত্যা করা হয় অসংখ্য পুলিশ সদস্যদেরকে। হামলা, ভাংচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের তান্ডব চলে প্রায় লক্ষাধিক লীগ সংশ্লিষ্ট নেতা-কর্মী-সমর্থকদের বাসা-বাড়ী ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও।অস্ত্রাগার লুট ও থানায় হামলা ভাংচুর করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে বেশ কয়েকজন, আবার লুটপাট অগ্নিসংযোগ করতে গিয়েও নিজেদের আগুনে অগ্নিদগ্ধ হয়ে নিহত হয়েছে অনেকে। অবাক করার বিষয় হলো নিহত এসব দুর্বৃত্তদের প্রায় সবাই শহীদ গেজেটে স্থান পেয়েছে !!
আগের পোষ্টগুলোতে বলেছি সরকার প্রকাশিত এই গেজেটে শুধুমাত্র ‘শহীদ’ এক সংখ্যা বৃদ্ধি করার জন্য জন্য ৫ই আগস্টের আগে ও অনেক পরেও ধর্ষন করার পর গণপিটুনিতে, কারাগার থেকে পালাতে গিয়ে, কারাগারে হামলা করতে গিয়ে, আওয়ামী লীগারদের বাড়ীঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লুটপাট – অগ্নিসংযোগ করার সময় নিজেদের আগুনে অগ্নিদগ্ধ হয়ে, আত্মঘাতি গুলিতে, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়, সম্পত্তি নিয়ে বিরোধের জেরে, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে, কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে, চাঁদাবাজি করতে গিয়ে গণপিটুনিতে – বিভিন্ন ভাবে নিহত হয়েছে এমন অনেক নাম গেজেটে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
এই শহীদ গেজেট তৈরীর ক্ষেত্রে স্থুল চাতুরতা অবলম্বন করে শহীদ (!) দের নিহত হওয়ার তারিখ, সময়, ঘটনাস্থল, নিহত হওয়ার কারন উল্লেখ করা হয়নি। নিহত ব্যক্তির বয়স এবং পেশাও উল্লেখ করা হয়নি। এমনকি অনেকেরই সঠিক ঠিকানা উল্লেখ করা হয়নি। তালিকাটি তৈরীতে বিভাগ বা জেলাওয়ারি কোন পদ্ধতি অনুসরন করা হয়নি। একেবারে সহজ বানানও ইচ্ছাকৃত ভুল করা হয়েছে, ফলে কোন নিহতের তথ্য পেতে বা তালিকার কারো নাম যাচাই করতে কিংবা লিপিবদ্ধ তথ্যের সত্য-মিথ্যা যাচাই করা প্রায় অসম্ভব।

এই গেজেটের সব থেকে বড় স্ক্যাম এর একটি হলো, আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্যের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যশোরের জাবির ইন্টারন্যাশনাল হোটেলে হামলা ভাংচুর ও লুটপাটের পরে আগুন ধরিয়ে সমস্ত কিছু পুড়িয়ে দেয়ার পরে, নিজেদের দেয়া সেই আগুনে অগ্নিদগ্ধ হয়ে আত্মঘাতি মৃত্যুবরণ করা ২০ জন দুর্বৃত্তের নাম শহিদ গেজেটে অন্তর্ভুক্ত হওয়া !!!
উল্লেখ্য, ৫ই আগষ্ট বিকালে সাড়ে ৩টার দিকে সমন্বয়ক হারুন অর রশিদ এর নেতৃত্বে যশোর শহরে একটি বিজয় মিছিল হয়। ঐ মিছিল থেকে দুর্বৃত্তরা যশোরের চিত্রা মোড়ে অবস্থিত ‘আওয়ামী লীগ নেতা ও সংসদ সদস্য শাহিন চাকলাদারের ১৬ তলাবিশিষ্ট অভিজাত পাঁচ তারকা হোটেল ‘জাবির ইন্টারন্যাশনাল’’ এ হামলা করে ভাংচুর ও লুটপাট চালায়। লুট করে নিয়ে যাওয়া হয় বালিশ থেকে শুরু করে হোটেলের খাট, ফ্রিজ, এসি, টিভিসহ বিলাসবহুল সমস্ত জিনিসপত্র। এমনকি পরদিন মঙ্গলবার (০৬ আগস্ট) দুপুর ২টা পর্যন্তও যে যেভাবে পেরেছে ভেতরে পুড়ে যাওয়া বালিশ, কাঁথা, বিছানা, চাদর থেকে শুরু করে জিনিসপত্র ভেঙে খুলে লুটপাট করে নিয়ে গেছে।
ঐ একই দিন অর্থাৎ ৫ই আগস্ট বিকালে প্রথম হামলার ঘন্টাখানেক পর দ্বিতীয় দফায় দুর্বৃত্তরা পুনরায় জাবির হোটেলে হামলা চালায়। তখন দুর্বৃত্তদের একটি অংশ হোটেলটির বেজমেন্টে ঢুকেই ভাংচুর ও লুটপাট করতে করতে উপরের ১২, ১৩ ও ১৪ তলায় পৌছায়। হামলাকারীরা যখন উপরের বিভিন্ন ফ্লোরে লুটপাটে ও হোটেলের বারে মদ্যপানে ব্যস্ত ছিলো তখন আরেকটি গ্রুপ গান পাউডার ও পেট্রোল ছিটিয়ে নীচে আগুন ধরিয়ে দিলে মুহুর্তে সেই আগুন ছড়িয়ে যায় পুরো ১৬ তলা ভবনে। ফলে ওপরের দিকে লুটপাটে ব্যস্ত থাকা অনেকেই আগুন ও ধোঁয়ার কারনে নীচে নামতে পারেনি। এতে নিহত হয় ২৪ জন, গুরুতর আহত হয় প্রায় সমসংখ্যক। নিহত ২৪ জনের মধ্যে শুধু মাত্র ১ জন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে, বাকী ২৩ জনের সবাই হোটেলেই আগুনের ধোয়ায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে ও আগুনে পুড়ে মারা গেছে। হোটেলে তৃতীয় তলার মদের বার থেকেও কয়েকজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। জানা যায় নিহতদের মধ্যে দুজন হোটেলের কর্মচারী ও অন্য এক জন ইন্দোনেশিয়ান নাগরিক ছিলো। যদিও স্থানীয় অনেকেই দাবী করেন এই ঘটনায় নিহতের সংখ্যা আরো বেশী। রাত সাড়ে ৯টার দিকে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও পরদিন মঙ্গলবার ভোর ৫টার দিকে পুরোপুরি আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। নিহতদের স্বজনেরা মরদেহ শনাক্ত করে নাম ঠিকানা, পরিচয় লিপিবদ্ধ করে সব মরদেহ ময়নাতদন্ত ছাড়াই হাসপাতাল থেকে বাড়িতে নিয়ে গেছে। ( https://www.prothomalo.com/bangladesh/district/9b7le5kxzp )
নিহতদের মধ্যে ‘শহীদ গেজেট’ এ থাকা ২০ জন হলোঃ রোকনুজ্জামান রাকিব, শাওয়ান্ত মেহতাব, তারেক রহমান, আবরার মাসনুন, ইউসুপ আলী, আব্দুল্লাহ ইবনে শহীদ, মেহেদী হাসান আলিফ, ইমতিয়াজ আহমেদ জাবির, সাকিব, সাকিবুল হাসান মাহি, রুহান ইসলাম, সামিউর রহমান সাদ, মেহেদী হাসান, ফয়সাল হোসেন, হাফিজ উদ্দিন, সোহানুর রহমান, তৌহিদুর রহমান রানা, ফজল মাহাদী চয়ন, রিয়াদ শেখ ও মিথুন মোরশেদ।
উল্লেখ্য, গেজেটের ৩৩৫ নাম্বারে রয়েছে #রুহান_ইসলাম এর নাম, রুহান পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী আক্তারুজ্জামান ডিকু বাহিনীর সদস্য।
গেজেটের ৫২২ নাম্বারে আছে হত্যা মামলার আসামী #ফজল_মাহাদী_চয়ন এর নাম। চয়ন এলাকায় মাদক ব্যবসা ও চাঁদাবাজির সঙ্গেও জড়িত ছিলো। অভিযোগ আছে তার সৎ পিতা পুলিশ সদস্য হওয়ায় আগে অনেক মামলা থেকে সে বিভিন্ন সময় রেহাই পেয়েছে।
গেজেটের ৬৯১ নাম্বারে আছে নিহত সন্ত্রাসী চয়নের সহযোগী #রিয়াদ_শেখ এর নাম, রিয়াদ শেখ যশোর বিএনপি নেতা কাবিল শেখ এর ছেলে।
দুর্ভাগ্যবশত কয়েকটি পত্রিকায় প্রকাশিত হলেও কমপক্ষে তিনজনের নাম গেজেটে পাওয়া যায় নাই; তারা হলোঃ
১. যশোর জিলা স্কুলের ১০ শ্রেণির ছাত্র রেলগেট ডালমিল এলাকার আবু সাঈদের পুত্র মাহিন (১৬),
২. সদরের ফতেপুর দাইতলা গ্রামের শওকত আলীর ছেলে সেজান হোসেন (২১) এবং
৩. রাতুল (১৭)।
পরবর্তীতে ১৮ই আগষ্ট ‘জাবির ইন্টারন্যাশনাল’ এর মালিক শাহীন চাকলাদারের চাচাতো ভাই সদর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান তৌহিদ চাকলাদার ফন্টু জাবির ইন্টারন্যাশনাল লুটপাট ও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনায় অজ্ঞাতনামা ২শ’ সন্ত্রাসীকে আসামি করে একটি মামলাটি করেন। ( https://www.prothomalo.com/bangladesh/district/0a3pb2m9i8 )
এই গেজেটের সব থেকে বড় স্ক্যাম এর দ্বিতীয়টি হলো, হামলা-ভাংচুর-লুটপাট ও অগ্নিসংযোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে দায়ের করা এই মামলায় অপরাধী হিসেবে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী-সমর্থক দেরকেই ঐ মামলায় আসামী হিসেবে গ্রেপ্তার হয়রানী করা।( https://www.onenewsbd.com/2024/12/26/495161 )
শহীদ গেজেট সংক্রান্ত প্রথম পর্বের লিঙ্কঃ https://www.facebook.com/share/p/1C6QwaXRwn,
প্রথম পর্বের আপডেটঃ https://www.facebook.com/share/p/18GkUtBSxV,
এবং
দ্বিতীয় পর্বের লিঙ্কঃ https://www.facebook.com/share/p/16oN6oZFmo
তৃতীয় পর্বের লিঙ্কঃ https://www.facebook.com/share/p/1JLnWFq6cu
* * সামনের পর্ব আসবে শীঘ্রই, সেই পর্বেও থাকবে তথাকথিত শহীদ গেজেটে অন্তর্ভুক্ত শহীদদের বিষয়ে আরো চমকপ্রদ কিছু তথ্য।