৫ আগস্টের পর থেকে আমাদের জাতীয় ইতিহাস যেন উল্টোপথে হাঁটতে শুরু করেছে। দুই দশকের গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসকে ছুড়ে ফেলে এখন নতুন সংজ্ঞায় এক নতুন “বিজয়“, নতুন “স্বাধীনতা“, এমনকি “শহীদত্ব” প্রতিষ্ঠার অপচেষ্টা চলছে।
নতুন সংজ্ঞার শহীদ গেজেট
২০২৫ সালের তথাকথিত ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান শহীদ পরিবার ও পুনর্বাসন অধ্যাদেশ’-এ শহীদের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে
“জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে শহীদ অর্থ: জুলাই গণ–অভ্যুত্থান চলাকালে তৎকালীন সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা উক্ত সময়ে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সদস্যদের আক্রমণে মৃত্যুবরণকারী ব্যক্তি।”
কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, দুর্ঘটনা কিংবা হৃদরোগে মৃত্যুর ঘটনাও এই শহীদ গেজেটে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে—শর্ত একটাই: নিহত ব্যক্তি জুলাই ষড়যন্ত্রকারীদের পক্ষের হতে হবে।শুধু শহীদ মর্যাদাই নয়— এসব নামের বিপরীতে পরিবার পাবে নগদ অর্থ, মাসিক ভাতা, চাকরিতে কোটা, ফ্ল্যাট, ও অন্যান্য সুবিধা।
‘শহীদ’ ইয়াছিন ও শরীফ: ধর্ষণ ও গণপিটুনির বিভীষিকাময় গল্প
গেজেটের ১৫৭ নম্বর শহীদ সাইদুল ইসলাম ইয়াছিন ও ৮২৭ নম্বর শহীদ সাইফ আরাফাত শরীফ।
তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ—১৩ আগস্ট যাত্রাবাড়ী এলাকার এক আবাসিক হোটেলে তল্লাশির নামে হয়রানি, পরে কুমিল্লা থেকে আগত এক দম্পতিকে আটক করে গৃহকর্তাকে অন্য কক্ষে রেখে নারীর উপর গণধর্ষণ করে।পরবর্তীতে স্থানীয় শিক্ষার্থীদের সহায়তায় তারা পুলিশের কাছে হস্তান্তরিত হয় এবং গণপিটুনিতে নিহত হয়। একই দিনে ধর্ষণের আরেকটি ঘটনায় হোটেল রোজ ভিউর ব্যবস্থাপক রাহাত হাসান বিপুকেও পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
🔗 সংবাদ লিংক: সমকাল
তবুও আশ্চর্যভাবে ইয়াছিনের মা শিল্পী আক্তার এবং শরীফের মা মরিয়ম দুজনই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদেরসহ মোট ৩৩৯ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন — যদিও ঘটনাটি ঘটে শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর।
🔗 বাংলা ট্রিবিউন প্রতিবেদন
🔗 যাত্রাবাড়ী ঘটনা নিয়ে আগের পোস্ট

১৭৯ নম্বর শহীদ: চাঁদাবাজ আবু সাঈদ
ডেমরার যুবদল নেতা আবু সাঈদ ছিলেন চিহ্নিত চাঁদাবাজ। তার নামে ছিল একাধিক মামলা।
৫ আগস্ট পরবর্তী পরিস্থিতিতে সে এলাকায় চাঁদাবাজি ও তাণ্ডব চালায়, যার জেরে এলাকাবাসী ক্ষুব্ধ হয়ে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করে।
🔗 আজকের পত্রিকা প্রতিবেদন
৭৯৭ নম্বর শহীদ: প্রকল্প কর্মকর্তা ফিরোজ আহমেদ
৫ আগস্ট যশোর শহরের লোন অফিসপাড়ায় ফিরোজ আহমেদের বাসায় দুর্বৃত্তরা আগুন লাগিয়ে দেয়। পরিবারের সদস্যদের বাঁচাতে গিয়ে ধোঁয়ায় দমবন্ধ হয়ে তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর সার্টিফিকেটে উল্লেখ করা হয়—
“ফেইলুর ডিউ টু স্মোক ইনহেলেশন ও হঠাৎ হৃদক্রিয়া বন্ধ।”
তবুও তাকেও শহীদ হিসেবে গেজেটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
🔗 যুগান্তর প্রতিবেদন
৩৭৪ নম্বর শহীদ: লিমন নিজের পক্ষের হাতে নিহত
রবিউল ইসলাম লিমন একজন এনসিপি সমর্থক হিসেবে বিজয় মিছিলে অংশ নিতে গিয়ে ভুল সন্দেহে আন্দোলনকারী উন্মত্ত মবের হাতে খুন হন। কেউ তাকে পুলিশ, কেউ ছাত্রলীগ ক্যাডার বলে প্রচণ্ড মারধর করে গাছের সঙ্গে উল্টো ঝুলিয়ে হত্যা করে।
তার পরিবার লাশ নিতে গেলে বাধা দেওয়া হয়।
🔗 আজকের পত্রিকা প্রতিবেদন
🔗 লিমনের স্ত্রীর পোস্ট
🔗 লিমনের ফেসবুক প্রোফাইল
গেজেটে তার পরিচয় অস্পষ্টভাবে দেওয়া হয়েছে — পুরো নাম নেই, পিতার নামের আগে “মৃত” লেখা হয়নি, ঠিকানা অনুল্লিখিত।
পরিকল্পিত অস্পষ্টতা: শহীদ তালিকা না কি বিভ্রান্তির দলিল?
৮৩৪ জনের তথাকথিত শহীদ তালিকা তৈরি হয়েছে—
- মৃত্যুর কারণ, সময়, স্থান অনুল্লিখিত
- অনেক নামেই পেশা, বয়স, ঠিকানা নাই
- বানান ভুল, এলোমেলো বিন্যাস
- বিভাগ বা জেলা ভিত্তিক কোনো শ্রেণিবিন্যাস নেই
উদ্দেশ্য: কেউ যেন যাচাই করতে না পারে শহীদ তালিকার বাস্তবতা।
সত্যের প্রশ্ন
ধর্ষণের দায়ে গণপিটুনিতে নিহত, চাঁদাবাজি করতে গিয়ে খুন হওয়া, নিজের পক্ষের সহিংসতায় প্রাণ হারানো, কিংবা ফিরোজ আহমেদের মতো হৃদরোগে মৃত্যুবরণকারী— এরা কীভাবে শহীদ হতে পারেন?
এইভাবে পরিকল্পিতভাবে গেজেটের তালিকা দীর্ঘ করে একটি রাজনৈতিক বর্ণনা প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে, যা শহীদের মর্যাদাকে অবমাননা করে।এই গেজেট একটি গুরুতর নৈতিক ও রাজনৈতিক প্রশ্ন উত্থাপন করে: শহীদের মর্যাদা কি রাজনৈতিক সুবিধার জন্য বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত হয়েছে? নানা অপরাধ ও দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের শহীদ ঘোষণা করে সরকার শুধু শহীদত্বের পবিত্রতাকেই ক্ষুণ্ন করেনি, বরং একটি ঐতিহাসিক আন্দোলনের সত্যিকারের আত্মত্যাগীদের অপমান করেছে। এই ধরনের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিকৃতি কেবল ইতিহাসকে ভুলভাবে উপস্থাপনই নয়, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নৈতিক বোধকেও ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়। শহীদের মর্যাদা রক্ষা করতে হলে সত্য ও দলনিরপেক্ষতা বজায় রাখা জরুরি।
পূর্ববর্তী পর্বসমূহ
🔗 প্রথম পর্ব: https://www.facebook.com/share/p/1C6QwaXRwn
🔗 প্রথম পর্বের আপডেট: https://www.facebook.com/share/p/18GkUtBSxV
🔗 দ্বিতীয় পর্ব: https://www.facebook.com/share/p/16oN6oZFmo
📌 পরবর্তী পর্বে আসছে তথাকথিত শহীদ গেজেটে অন্তর্ভুক্ত আরও কিছু বিতর্কিত নাম ও ঘটনার বিশ্লেষণ।