গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আলোচনায় উঠে আসে ২০২২ সালে নির্বাসিত সাংবাদিক তাসনিম খলিল ও বিতর্কিত সাবেক সেনাক্যাডেট জুলকারনাইন সায়েরের প্রতিবেদন ‘আয়নাঘর’। প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, এটি ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে চালানো একটি গোপন বন্দিশালা। তবে ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে আয়নাঘর সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য দিয়েছে। কেউ বলছে, এমন স্থাপনা ছিল, আবার কেউ বলছে, এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। আয়নাঘর জনসম্মুখে উপস্থাপন করতে না পারায় বিষয়টি নিয়ে জনমনে তৈরি হয়েছে বিভ্রান্তি।
বিতর্কের মধ্যে ১৯৯২ সালে প্রকাশিত হুমায়ূন আহমেদের ভৌতিক উপন্যাস ‘আয়নাঘর’-এর প্রসঙ্গও সামনে আসে। উপন্যাসে তাহের ও লিলিয়ানের প্রেমকাহিনি, পৈতৃক বাড়িতে তাদের ভয়ংকর অভিজ্ঞতা এবং অতৃপ্ত আত্মার উপস্থিতির গল্প বর্ণিত হয়েছে। উপন্যাসের সঙ্গে নেত্র নিউজের ‘আয়নাঘর’-এর কোনো সম্পর্ক নেই, তবে নামের মিল নিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে।
২০২২ সালে নেত্র নিউজে প্রথমবারের মতো ‘আয়নাঘর’ সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, এটি ছিল সরকারের সমালোচকদের নির্যাতনের গোপন কেন্দ্র। তবে সে সময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার এবং নিরাপত্তা বাহিনী এ ধরনের কোনো স্থাপনার অস্তিত্ব অস্বীকার করে। তাসনিম খলিল ও জুলকারনাইন সায়েরের এই প্রতিবেদন দেশে-বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করলেও তথ্যের অভাব এবং তথ্যদাতাদের পরিচয় গোপন রাখার কারণে সেটির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ধারণা করা হচ্ছিল, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ‘আয়নাঘর’ নিয়ে স্বচ্ছ তথ্য প্রকাশ করবে। কিন্তু ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও তা হয়নি। ফলে এই বিতর্ক আরও গভীর হয়েছে। আয়নাঘরের অস্তিত্ব নিয়ে তদন্তের কোনো আপডেট নেই। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, এটি সত্য নাকি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচার? সরকারের তরফে বিষয়টি নিয়ে নানা মত থাকলেও জনমনে কৌতূহল রয়েই গেছে—আসলেই কি ছিল আয়নাঘর? নাকি এটি শুধুই একটি রাজনৈতিক প্রচার?
বাংলাদেশের মিডিয়ার ভাষ্য অনুযায়ী আমরা বিভিন্ন লোমহর্ষক মুখরোচক খবর শুনে থাকি, যার কিঞ্চিত সত্যতা আছেও বটে। বহুল আলোচিত আয়নাঘরের হদিস মিলে নেত্র নিউজের সংবাদ থেকে।
নেত্র নিউজের রিপোর্ট অনুযায়ী এক কারাবন্দির ভাষ্যমতে সেলিম অনুমান করেছিলেন যে আশেপাশে হয়তো কোন বিমানঘাঁটি বা বিমানবন্দর আছে। তবে হাসিনুর নিশ্চিত করেই জানান
যে, বিমান উঠানামার শব্দ আসতো তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে, যেখানে রুটিন বিমান বা বিমান ও সেনা বাহিনীর সেনা প্লেন উঠানামা করে। নেত্র নিউজের রিপোর্টে আয়নাঘরের সেলের কয়েকটি ছবিও প্রকাশিত হয়, ছবিগুলোতে দেখা যায় সেলগুলো বেশ পুরনো।
‘ট্রু গেজেট’ বাংলাদেশের যেকোন একটি জেলার জেলারের সাথে কথা বলে নিশ্চিত হয়েছে এই সেলগুলো দেশের প্রত্যেকটি জেলায় ছিল আগে, এই
সেলগুলো আয়নাঘর নামে চালিয়ে দেওয়ার সত্যতা নিয়ে তিনি সন্দিহান, কারণ দেশে অনেকগুলো কারাগারে এধরণের রুমের অস্তিত্ব আছে,এসবে মুলত জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়, দাগী আসামিদের রাখা হয় বিশেষ প্রটোকল অনুসরণ করে।
আয়নাঘর বিতর্ক: নতুন তথ্যের অভাব, ঘুরেফিরে নেত্র নিউজই ভরসা
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আয়নাঘর নিয়ে নানা করুণ কাহিনি প্রকাশ পেলেও, মূলধারার সংবাদমাধ্যমে নতুন কোনো তথ্য দেখা যাচ্ছে না। দেশের পত্রিকাগুলোতে ছাপা হওয়া প্রতিবেদনগুলোতে ঘুরেফিরে নেত্র নিউজের করা অনুসন্ধানেরই পুনরাবৃত্তি দেখা যাচ্ছে। অনেক সংবাদেই তথ্যসূত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে নির্বাসিত সাংবাদিক তাসনিম খলিল ও বিতর্কিত সাবেক সেনাক্যাডেট জুলকারনাইন সায়েরের প্রতিবেদন। ফলে আয়নাঘর নিয়ে যুগান্তর, ইত্তেফাকসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে ছাপা হওয়া খবরগুলো মূলত ডেস্ক রিপোর্টেই সীমাবদ্ধ থাকছে। নতুন তথ্যের অভাবের কারণে এই সংক্রান্ত বেশিরভাগ প্রতিবেদনই রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট (স্টেট-স্পন্সর্ড) বলে সন্দেহ প্রকাশ করছেন নেটিজেনরা ।

ফলত আয়নাঘর নিয়ে বেশিরভাগ যুগান্তর ডেস্ক, ইত্তেফাক ডেস্ক রিপোর্ট ডেস্ক রিপোর্ট হিসেবে ছাপা হয়েছে দেশের সংবাদমাধ্যমে। প্রতিবেদকের পরিচয় প্রকাশ না করে একই সংবাদ বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে ডেস্ক রিপোর্ট এর আড়ালে প্রকাশ এই সংক্রান্ত সকল সংবাদ স্টেট স্পন্সর্ড কিনা সে প্রশ্নে ট্রু গেজেটের এই অনুসন্ধান ।
আয়নাঘর নিয়ে রহস্যের ডালপালা মেলেছে ইউনুস সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের বক্তব্যের সূত্র ধরেঃ
৬ ডিসেম্বর পুলিশের আইজিপি বাহারুল আলম বলেন “
কোনো আয়নাঘর নেই, পুলিশ এখন ‘ওপেন“খুন, গুম, আয়নাঘর- এই সংস্কৃতি তো এখন আর নাই। সরকার শুধরানোর চেষ্টা করছে। তাহলে আমরাই বা কেন তথ্য চেপে রাখব। আমাদের তো এরকম কোনো দুর্বলতা নেই। এরকম দুর্বলতা থাকলে তথ্য চেপে রাখার কথা, যেটা আগেও হয়েছে বিভিন্ন সময়।”
৭ অক্টোবর,২০২৪ র্যাবের ডিজি বলেন র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন (র্যাব) গুম-খুনের সঙ্গে কোনোভাবেই জড়াবে না বলে জানিয়েছেন বাহিনীটির মহাপরিচালক (ডিজি) এ কে এম শহিদুর রহমান। তিনি বলেন, র্যাবে আয়নাঘর বলে কিছু নেই আর বিচারবহির্ভূত কোনোকিছু হওয়ার সুযোগ নেই।
যদিও র্যবের বর্তমান ডিজি ১২ ডিসেম্বর বলেন
র্যাবের আয়নাঘর ছিল এখনও আছে
এক সপ্তাহের ব্যবধানে র্যাব এর ডিজি এবং পুলিশের আইজিপির দুই ধরণের বক্তব্য আয়নাঘরের সত্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
যদিও ২১ আগস্ট ডেইলি স্টার আয়নাঘর নিয়ে প্রতিবেদনে উল্লেখ করে এই ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনা একত্রিত করলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, এর মধ্যে অনেকগুলো প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা পরিদপ্তর (ডিজিএফআই) পরিচালিত ছিল। যুগান্তর নেত্র নিউজের বরাত দিয়ে বলছে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর কাউন্টার-টেরোরিজম ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো (সিটিআইবি) দ্বারা পরিচালিত ছিল। কোন সংবাদ মাধ্যম বলছে ডিজিএফআই আয়নাঘর পরিচালনা করতো, কোন সংবাদ মাধ্যম বলছে সিটিআইবি আয়নাঘর পরিচালনায় ছিল, আবার পুলিশ বলছে আয়নাঘরের অস্তিত্ব নেই ,র্যাব একবার বলছে আয়নাঘর আছে, আরেকবার বলছে নেই।আয়নাঘর নিয়ে বিভিন্ন সময় র্যাব পুলিশের বিভিন্ন রকম বক্তব্য শোনা গেলে ও এখন পর্যন্ত ডিজিএফআইইয়ের দায়িত্বশীল কারো মন্তব্য শোনা যায়নি। ফলে আয়নাঘরের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ আরো ঘনীভূত হচ্ছে।
নেত্র নিউজ ২০২২ সালে আয়নাঘর নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল, যেখানে বন্দীশালার কক্ষগুলো পুরনো, জরাজীর্ণ এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন বলে বর্ণনা করা হয়েছিল। রুমের জানালা, গ্রিল, এবং সামগ্রিক পরিবেশে ছিল অব্যবস্থাপনার ছাপ। কিন্তু ২০২৫ সালে প্রকাশিত নতুন ছবিতে দেখা যায় সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। রুমগুলো ভিন্ন আকৃতির, জানালা এবং গ্রিলের নকশা পরিবর্তিত, এবং পুরো ভবনটি চকচকে নতুন রঙে সজ্জিত। এমনকি দেয়ালগুলোতেও নতুন রঙের প্রলেপ দেওয়া হয়েছে। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের ছয় মাস পর এই নতুন ছবি প্রকাশিত হওয়ায় আয়নাঘরের অস্তিত্ব এবং অতীত বর্ণনা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, আয়নাঘরের বাস্তবতা কি আদৌ ছিল? যদি থাকত, তবে ২০২২ এর প্রতিবেদন এবং ২০২৫ এর ছবির মধ্যে এত বড় পার্থক্য কেন? এর পেছনে কোনো সরকারি প্রচারণা নাকি বাস্তবিক সংস্কারের কৌশল লুকিয়ে আছে, তা এখনো অস্পষ্ট। অনেকেই বলছেন, ২০২২ এর ছবিগুলো পরিকল্পিতভাবে সাজানো হয়েছিল নাকি নতুন সরকারের চাপের মুখে আয়নাঘর নিয়ে নতুন ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে ২০২৫ এ নতুন স্থাপনা নির্মাণ করে?
আয়নাঘর: আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে গোপন কারাগারের বাস্তবতা
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গোপন কারাগার বা জিজ্ঞাসাবাদ কেন্দ্র সম্পর্কে যে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে, তা আসলে নতুন কিছু নয়। পৃথিবীর অনেক দেশেই এধরনের কেন্দ্র রয়েছে, যেখানে সন্দেহভাজনদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তবে, আয়নাঘর সম্পর্কে যে অত্যাচারের বর্ণনা দেয়া হয়েছে, তা অত্যন্ত লোমহর্ষক, যা জনমনে চাঞ্চল্য তৈরি করেছে।
বিশ্বব্যাপী, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, যুক্তরাজ্য এবং পাকিস্তান-এর নিরাপত্তা বাহিনীর গোপন জিজ্ঞাসাবাদ কেন্দ্রগুলো ব্যাপক আলোচিত। যেমন গুয়ানতানামো বে (যুক্তরাষ্ট্র)-এর কুখ্যাতি, যেখানে বহু দেশব্যাপী আলোচনা হয়েছে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে। সৌদি আরবেও গোপন কারাগারের কার্যক্রম বেশ কিছু সময় ধরে আলোচনায় রয়েছে, যেখানে সন্দেহভাজনদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। যুক্তরাজ্য এবং পাকিস্তানেও সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রমের সন্দেহে গোপন জিজ্ঞাসাবাদ কেন্দ্রগুলো পরিচালিত হয়ে থাকে।বাংলাদেশে আয়নাঘরও আসলে অন্যান্য দেশের গোপন জেল বা কারাগারের মতোই হতে পারে, যেখানে নিরাপত্তা বাহিনীগুলো দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়।বিশ্বের সামরিক বাহিনী এবং নিরাপত্তাবাহিনী সারা দুনিয়ায় বিভিন্ন সময়ে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার স্বার্থে এধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। ফলে, এই ধরনের কেন্দ্রের অস্তিত্ব কোনো একক দেশ বা সরকারের বিশেষত্ব নয়, বরং নিরাপত্তা পরিচালনার অংশ হিসেবে এটি বহু দেশের অভ্যন্তরীণ নীতির অংশ।
আসুন জেনে নেই দুনিয়াজুড়ে আয়নাঘরের ইতিহাস…
যুক্তরাস্ট্রের আয়নাঘর

গুয়ানতানামো: গোপন বন্দিশালার নেটওয়ার্ক এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন
৯/১১ হামলার পর থেকে গোপন বন্দিশালার একটি নেটওয়ার্কে ৩,০০০-এরও বেশি আল-কায়েদা সন্দেহভাজনকে বিচার ছাড়াই আটক রাখা হয়েছে, যার মধ্যে অনেককে শিকার হতে হয়েছে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের। যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্র দেশগুলো এই বন্দিশালাগুলো পরিচালনা করছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে গুয়ানতানামো বে, আফগানিস্তানের বাগরাম এয়ার বেস এবং মধ্যপ্রাচ্য ও দূরপ্রাচ্যের অন্যান্য স্থান। যুক্তরাজ্যের দ্যা গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত পত্রিকা থেকে জানা যায়
জিজ্ঞাসাবাদের পদ্ধতিগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ওয়াটারবোর্ডিং, ঘুম বঞ্চিত করা, শারীরিক নির্যাতন, দীর্ঘ সময় ধরে দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা এবং মানসিক চাপ সৃষ্টি করা। এই কঠোর পদ্ধতিগুলো অনেক ক্ষেত্রেই তথ্য সংগ্রহের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে, যদিও যুক্তরাষ্ট্রে এগুলো নিষিদ্ধ।
গুয়ানতানামো বে ডিটেনশন ক্যাম্প (গিটমো) কিউবার দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে অবস্থিত একটি মার্কিন সামরিক কারাগার, যা ২০০২ সালে ৯/১১ হামলার পর আল-কায়েদা ও তালিবান সন্দেহভাজনদের আটক করতে প্রতিষ্ঠিত হয়। বন্দীদের “অবৈধ শত্রু যোদ্ধা” হিসেবে ঘোষণা করে তাদের জেনেভা কনভেনশনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়।
এই কারাগারটি নির্যাতন, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গের অভিযোগে বিশ্বব্যাপী বিতর্কের কেন্দ্রে রয়েছে। ২০০৬ সালে মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয় যে, সামরিক ট্রাইব্যুনাল জেনেভা কনভেনশন লঙ্ঘন করেছে। ২০০৮ সালে বন্দীদের হেবিয়াস কর্পাস (অবাধ মুক্তির অধিকার) দেওয়ার পরও অনেককে মুক্তি দেওয়া সম্ভব হয়নি।
বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার সংগঠন এবং বৈশ্বিক সম্প্রদায় গুয়ানতানামো বন্ধের দাবি জানালেও এটি এখনও চালু রয়েছে, এবং কয়েক ডজন বন্দী এখনও সেখানে আটক আছেন। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কারাগারটি বন্ধের ইচ্ছা প্রকাশ করলেও, তা বাস্তবায়িত হয়নি। গুয়ানতানামো এখন যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের একটি বিতর্কিত প্রতীকে পরিণত হয়েছে, যা মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে বিশ্বব্যাপী সমালোচিত।
যুক্তরাজ্যে আয়নাঘরঃ

মিলিটারি কারেকটিভ ট্রেনিং সেন্টার (MCTC), যা এসেক্সের কোলচেস্টারে অবস্থিত, এটি ব্রিটেনের একমাত্র সামরিক আটক কেন্দ্র। এখানে একসঙ্গে ২৮৪ জন বন্দী রাখা যায়, যাদের “ডিটেইনি আন্ডার সেনটেন্স” (DUS) বলা হয়। তারা ১৪ দিন থেকে ২ বছরের মধ্যে শাস্তি ভোগ করেন, যা অনুপস্থিতি (AWOL), দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা বা অধীনস্তদের হয়রানির মতো অপরাধের জন্য দেওয়া হয়।বন্দীদের তিনটি বিভাগে বিভক্ত করা হয়: যারা সেনাবাহিনীতে ফেরত যাবেন (এ কোম্পানি), যারা বেসামরিক জীবনে ফিরবেন (ডি কোম্পানি), এবং যারা তদন্ত বা স্থানান্তরের অপেক্ষায় আছেন। এ কোম্পানি সামরিক পুনর্বাসনের জন্য শৃঙ্খলা ও মনোবল বৃদ্ধির উপর কাজ করে, আর ডি কোম্পানি বেসামরিক জীবনের জন্য পুনর্বাসন ও পেশাগত প্রশিক্ষণ প্রদান করে।MCTC প্রথমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের একটি যুদ্ধবন্দী শিবির (POW ক্যাম্প) ছিল এবং ১৯৭৬ সালে হংকংয়ের স্টোনকাটার্স আইল্যান্ড MCTC বন্ধ হওয়ার পর এটি এই ধরনের একমাত্র স্থাপনা হিসেবে রয়ে গেছে।
ফিলিপাইনে গোপন কারাগার
ফিলিপাইনে রাষ্ট্রপতি দুতার্তে মাদকবিরোধী অভিযানে দাগী অপরাধীদের রাখার জন্য গোপন কারাগার তৈরি করেন।

বিবিসির রিপোর্ট অনুযায়ী
ফিলিপাইনের ম্যানিলায় একটি পুলিশ স্টেশনে গোপন জেল সেল আবিষ্কৃত হওয়ার পর স্টেশনের প্রধানকে বরখাস্ত করা হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর অভিযোগ, এই সেলে মাদক সন্দেহভাজনদের আটকে রেখে অর্থের বিনিময়ে মুক্তি দেওয়া হতো। এক ডজন পুরুষ ও নারীকে একটি ছোট সেলে ভিড় করে রাখা হয়েছিল, যেখানে তারা নির্যাতনের শিকার হয়েছে এবং প্লাস্টিকের ব্যাগে মলমূত্র ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে বলে দাবি করেছে।
পুলিশ কমান্ডার এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, মাদক সন্দেহভাজনদের সংখ্যা বেশি হওয়ায় ওভারক্রাউডিং এর কারণে তাদের গোপন সেলে রাখা হয়েছিল। তবে এই ঘটনা রাষ্ট্রপতি রড্রিগো দুতার্তের বিতর্কিত মাদকবিরোধী অভিযানের অধীনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের উদ্বেগকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। দুতার্তের মাদকবিরোধী অভিযানে ইতিমধ্যে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছে।
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, পুলিশ ব্যক্তিগত লাভের জন্য এই অভিযানকে অপব্যবহার করছে। রাষ্ট্রপতি দুতার্তে পূর্বে পুলিশের দুর্নীতির কথা স্বীকার করলেও মাদকবিরোধী অভিযান চালিয়ে যাচ্ছেন। এই গোপন কারাগার ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো ফিলিপাইনের মাদকবিরোধী নীতির নৈতিকতা ও কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
পাকিস্তানে গোপন কারাগারে নির্যাতন

নিউইয়র্ক টাইমস এবং গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন থেকে জানা যায় পাকিস্তানের কোহাট জেলে সামরিক আটককেন্দ্রে বন্দীদের বিরুদ্ধে নির্যাতন ও মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, গত দেড় বছরে এই ধরনের বেশ কয়েকটি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। একদিকে, নিযা বিবির ছেলে আসগর মুহাম্মদ-কে তালেবান সন্দেহে আটক করা হয়, ১৮ মাস পর তাকে দেখতে পেলেও এক মাস পর তার মৃত্যুসংবাদ পান নিযা বিবি।পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দীর্ঘ সময় ধরে তালেবানদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে শত শত মানুষকে আটক করেছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানায়, শুধুমাত্র পাকিস্তানের মিলিটারি কাস্টডিতে ২০১৪ সালে শতাধিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে, যেগুলোর সবই বিচার বহির্ভূত ছিল।
নিউইয়র্ক টাইমস এর ভাষ্যমতে, খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশ এবং উপজাতীয় অঞ্চলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পরিচালিত ৪৩টি গোপন কারাগার তথা আয়নাঘরের একটি নেটওয়ার্ক রয়েছে, যেখানে বন্দীদের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনরা তাদের পরিবারের সদস্যদের খোঁজে পেশোয়ার হাইকোর্টে ২১০০ টিরও বেশি মামলা দায়ের করেছেন।দ্যা গার্ডিয়ান রিপোর্ট করেছে, ১৯৭০ সাল থেকে পাকিস্তানে আইএসআই (ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স) দ্বারা গুম ও খুন শুরু হয়, যা এখনও অব্যাহত। পাকিস্তানের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো প্রায়ই এসব অভিযোগ অস্বীকার করে, তবে আইএসআই এবং সামরিক কর্মকর্তারা পাকিস্তানের পাহাড়ি অঞ্চলে গোপন স্থানগুলোতে বন্দীদের আটক করে রাখে এবং কখনো কখনো প্রচার করা হয় যে, তালেবানদের হাতে বন্দীরা নিহত হয়েছে।
পাকিস্তানে গোপন কারাগারের কার্যক্রম এবং গুম-খুনের ঘটনায় আন্তর্জাতিক মহলে তীব্র সমালোচনা চলছে, যা মানবাধিকার ও আইনের শাসনের প্রতি বড় একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সৌদি আরবের আয়নাঘর

খোদ সৌদি আরবেও এধরণের গোপন কারগারের দেখা মেলে। আল জাজিরার রিপোর্ট অনুযায়ীসৌদি আরবের কারাগারে নির্যাতনের অভিযোগ বেড়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, তিনজন সৌদি আলেমকে হত্যা করা হয়েছে এবং অনেক মানবাধিকার কর্মীকে বর্বরতার শিকার হতে হয়েছে। বিশেষত, নারী অধিকার কর্মী ইমান আল-নাফজান, লুজাইন আল-হাথলুল, সালমান আল-আওদাহ, ইয়াহিয়া আসিরি এবং অন্যান্য একটিভিস্টদের বিরুদ্ধে ব্যাপক নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে।
এদের মধ্যে বেশিরভাগকেই কারাগারে বৈদ্যুতিক শক, বেত্রাঘাত, এবং নির্জন কক্ষে বন্দী করে রাখা-এর মতো অত্যাচারের শিকার হতে হয়েছে। এমনকি তাদের উপর মানসিক নির্যাতনও চালানো হয়েছে। এই ধরনের নির্যাতনের পদ্ধতি সৌদি কারাগারে পুরনো হলেও, বর্তমানে তা আরও বেড়েছে বলে অভিযোগ করা হচ্ছে।সৌদি আরব UN Convention Against Torture-এ স্বাক্ষর করেছে, তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, দেশটিতে এখনও নির্যাতন ব্যাপকভাবে চলছে এবং এটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার নীতির বিরুদ্ধে সরাসরি চ্যালেঞ্জ। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মহল এবং মানবাধিকার সংগঠন এই নির্যাতন বন্ধের দাবি জানাচ্ছে, তবে সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে এখনো কোনো কার্যকরী পদক্ষেপের চিহ্ন দেখা যায়নি।এ ধরনের নির্যাতনের ঘটনা সৌদি আরবের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে প্রশ্ন তুলছে, যা দেশটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং প্রতিশ্রুতির প্রতি সন্দেহের সৃষ্টি করছে।
এল সালভাদরের গোপন জেলঃ গ্যাং যুদ্ধের বিরুদ্ধে সিকোট মেগা-জেল

বিবিসির রিপোর্ট অনুযায়ী এল সালভাদর বর্তমানে সন্ত্রাসী কার্যকলাপের জন্য বিশ্বের অন্যতম বিপজ্জনক দেশ হিসেবে পরিচিত। দেশটির প্রেসিডেন্ট নায়িব বুকেলের নেতৃত্বে গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী অভিযান শুরু হয়েছে। এর অংশ হিসেবে, সেন্টার ফর দ্য কনফিনমেন্ট অফ টেররিজম (সিকোট) নামে একটি মেগা-জেল খোলা হয়েছে। এই জেলটি গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে ঘোষিত “যুদ্ধের” একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যেখানে কমপক্ষে ৬৮,০০০ লোককে আটক করা হয়েছে যারা বিভিন্ন গ্যাংয়ের সদস্য বলে পরিচিত।
সিকোট, জানুয়ারিতে টেকোলুকা শহরে খোলা হয়েছে, যা সান সালভাদর শহরের ৭৪ কিলোমিটার (৪৬ মাইল) দক্ষিণে অবস্থিত। এই জেলটি ৪০,০০০ বন্দী ধারণ করতে সক্ষম, যাদের অধিকাংশই মারা সালভাত্রুচা (এমএস-১৩) এবং ব্যারিও ১৮ নামক দুইটি প্রতিদ্বন্দ্বী গ্যাংয়ের সদস্য। এই দুই গ্যাংয়ের মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে চলা সংঘর্ষের কারণে এল সালভাদরে সন্ত্রাস এবং রক্তপাতের মাত্রা অনেক বেড়ে গেছে।
রাষ্ট্রপতি বুকেলের কুখ্যাত “গ্যাংদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ” এর প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে সিকোট। দেশটির নিরাপত্তা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে যে, ২০২২ সালের মার্চে এই অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে কমপক্ষে ৬৮,০০০ জনকে আটক করা হয়েছে। সরকারের উদ্দেশ্য হলো, গ্যাং কার্যকলাপ কমিয়ে এল সালভাদরের নিরাপত্তা পরিস্থিতি উন্নত করা এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি করা।এটি প্রেসিডেন্ট বুকেলের একটি বড় পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে, যা এল সালভাদরের নিরাপত্তার অবস্থা পরিবর্তন করার লক্ষ্যে নেওয়া হয়েছে, তবে এই পদক্ষেপের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্নও উঠেছে আন্তর্জাতিক মহলে।
যুগান্তর নেত্র নিউজের বরাত দিয়ে বলছে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর কাউন্টার-টেরোরিজম ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো (সিটিআইবি) দ্বারা পরিচালিত একটি গোপন আটক কেন্দ্রের নাম আয়নাঘর। ধারণা করা হয়, এখানে কমপক্ষে ১৬টি কক্ষ রয়েছে, যেখানে একসঙ্গে ৩০ বন্দি রাখার সক্ষমতা রয়েছে। আয়নাঘরটি বাংলাদেশের ঢাকা সেনানিবাস এলাকায় অবস্থিত বলে ধারণা করা হয়।বাংলাদেশে বহুল আলোচিত আয়নাঘর মূলত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দেখা যায়, দাগী অপরাধী এবং ধুধর্ষ আসামীদের শাস্তি দেওয়ার এই রীতি যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, যুক্তরাজ্য, পাকিস্তান, ফিলিপাইনেও দেখা যায়। এসব আলোচিত আয়নাঘরে বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক বন্দীদের ও রাখা হতো। কিন্তু বাংলাদেশের আয়নাঘরকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে নেতিবাচকভাবে তা মেটিকুলাস ডিজাইনের অংশ কিনা এমন প্রশ্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুলছে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা।
সারা বিশ্বে সভ্য এবং উন্নত দেশগুলোতে গোপন বন্দিশালার উপস্থিতি একটি পরিচিত বাস্তবতা। তবে বাংলাদেশে আয়নাঘর নিয়ে যেভাবে গত কয়েক বছর ধরে প্রচার চলছে, তা অনেকের মতে বিভ্রান্তিকর এবং রহস্যময়। এসব গোপন বন্দিশালায় সাধারণত ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধ মত দমন, রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড প্রতিহত করতে অথবা সন্ত্রাসী-জঙ্গিদের আটক করতে অপরাধীদের বন্দী রাখা হয়। তবে প্রশ্ন উঠছে, বাংলাদেশের আয়নাঘরের গল্পটি কি সত্যিই বাস্তব, না কি এটি হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসের মতোই এক ধরনের ভৌতিক এবং রহস্যময় কল্পকাহিনী হয়ে দাঁড়িয়েছে? পৃথিবীর সকল উন্নত দেশে গোপন বন্দিশালার উপস্থিতি দেখা যায়, কিন্তু বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর ছয় মাসেও আয়নাঘরের রহস্য উন্মোচিত না হওয়ায়, এবং একেক সময়ে নিরাপত্তাবাহিনীর প্রধানদের একেক ধরনের বক্তব্য শোনার পর, বিরোধী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এটিকে ইউনূসের স্টেট স্পন্সর্ড প্রোপাগান্ডা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এদিকে, দেশের সুশীল সমাজ এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আয়নাঘরের অস্তিত্বের বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্তের আহ্বান জানিয়ে বলছেন, যদি আয়নাঘরের কোনো সত্যতা থাকে, তবে তা জাতির সামনে প্রকাশিত হওয়া উচিত। এই অবস্থায়, আয়নাঘর কী বাস্তবে ছিলো, নাকি একটি রাজনৈতিক চাল? এই প্রশ্নগুলো এখনও জাতির মনে রয়ে গেছে।