দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম তিনমাসে একনেক সভায় কয়েক হাজার কোটি টাকা ব্যয় বেড়েছে বেশ কয়েকটি চলমান প্রকল্পের। প্রশ্ন উঠেছে সংস্কার না অর্থ লোপাটে ব্যয় বাড়ানো হচ্ছে এসব প্রকল্পের।
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যূত্থানের পর ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশত্যাগ করেন দীর্ঘ ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ শাসনকার্য পরিচালনা করা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন নোবেলজয়ী ড. মোহাম্মদ ইউনূস এবং তার উপদেষ্টা মন্ডলী। ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে নেয়া হয় আন্দোলনে নেতৃত্ব দানকারী তিন জন ছাত্রনেতাকে।
শপথ গ্রহণের পর দেশের বিদ্যমান অরাজক পরিস্থিতির অবসান এবং সবক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কারের কথা বলা হয় সরকারের পক্ষ থেকে। দেশের মানুষ এবং সরকার পতনে অবদান রাখা সব পক্ষ আশা করে নতুন বাংলাদেশ গঠনের। কিন্তু দ্রুতই সে স্বপ্ন ফিকে হয় অব্যাহত চাঁদাবাজি, দখলবাজি এবং বাজার সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলা, সুফিদের মাজার ভাঙা এবং ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে ঢাকার বড় কলেজগুলোর মারামারি দেশজুড়ে অরাজক পরিস্থিতির জন্ম দেয়। এছাড়া আনসারদের আন্দোলন, অটো রিকশা চালকদের আন্দোলন, গার্মেন্টস কর্মীদের আন্দোলনে কারখানা বন্ধ থাকা সহ নানা কারণে দেশের উৎপাদন শিল্প চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যার প্রভাব পড়েছে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে।
ইউনূস সরকারের গত ১২০ দিনে দেশের অর্থনীতি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, আইএমএফ নির্ধারিত বিপিএম সিক্স পদ্ধতিতে আগস্টে রিজার্ভ ছিল প্রায় দুই হাজার ৪৭ কোটি ডলার এবং সেপ্টেম্বরে এক হাজার ৯৮৬ কোটি ডলার । অর্থাৎ গত তিনমাসে দেশের রিজার্ভ বাড়েনি বরং কমেছে ৬১ কোটি ডলার। অর্থনীতিবিদরা আশংকা করছেন আকুর দেনা পরিশোধ করার পর রিজার্ভ উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাবে। কারণ রপ্তানীযোগ্য পণ্য, গার্মেন্টস সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অস্থিরতার ফলে রেমিট্যান্স আয় কমেছে। এছাড়া ব্যাংক গুলো এলসি না খুলতে দেয়ায় আমদানিতে ব্যাপক সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে আমদানিকারকরা। সুত্রঃ বিবিসি।
দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা বরাবর খারাপের দিকে যাচ্ছে বলে মত দিয়েছে বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা দেয়ার জন্য ছাপিয়েছে নতুন সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি এবং ইতোমধ্যে দেশের খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাড়িয়েছে প্রায় ১৫ শতাংশে। যা নিকট অতীতে দেখা যায়নি। সুত্রঃ প্রথম আলো।
অর্থনীতির যখন এমন দৈন্য দশা, তখন নজর দেয়া যাক নতুন প্রকল্প গ্রহণ এবং প্রকল্পে সংশোধিত ব্যয় বৃদ্ধিতে অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা। দায়িত্ব গ্রহণের পর এর মধ্যে তিনবার প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের নেতৃত্বে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে প্রথম সভা সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় মোট চারটি উন্নয়ন প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ২২২ কোটি ১৪ লাখ টাকা। একনেকে অনুমোদিত দুটি নতুন প্রকল্প হলো ৫৮৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘দুটি মূল্যায়ন কাম উন্নয়ন কূপ (সুন্দলপুর-৪ ও শ্রীকাইল-৫) এবং দুটি অনুসন্ধানী কূপ (সুন্দলপুর দক্ষিণ-১ ও জামালুর-১)’ এবং ৪০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ে টেকসই সামাজিক পরিষেবা প্রদান প্রকল্প (দ্বিতীয় পর্যায়)’।
এ ছাড়া আরও দুটি সংশোধিত প্রকল্প হলো ৭০ দশমিক ৬৩ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয়ে ‘বাখরাবাদ-মেঘনাঘাট-হরিপুর গ্যাস ট্রান্সমিশন পাইপলাইন, প্রথম সংশোধিত’ এবং ১৬৩ দশমিক ১১ কোটি টাকার অতিরিক্ত ব্যয়ে ‘তথ্য আপা: আইসিটি টুওয়ার্ডস ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রকল্পের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন, (দ্বিতীয় পর্যায় ও দ্বিতীয় সংশোধিত)’। এ প্রকল্পের সময়সীমা এক বছরে কমিয়ে আনা হয়েছে। সূত্র: কালবেলা, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪। সূত্রঃ কালবেলা ।
অক্টোবরে অনুষ্ঠিত হওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের দ্বিতীয় একনেক বৈঠকে মোট চারটি প্রকল্প তোলা হয়। এর মধ্যে দুটি সংশোধিত এবং দুটি নতুন প্রকল্প। কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্পের মেয়াদ তিন বছর এবং ব্যয় ৬ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা বাড়িয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার, যা শতকরা হিসেবে প্রায় ৩৭ শতাংশ। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নেওয়া এই গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পের ব্যয় প্রথমে ধরা হয়েছিল ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি ২০ লাখ টাকা, মেয়াদ ধরা হয়েছিল ২০২৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত।প্রথম সংশোধনীতে প্রকল্পের খরচ সামান্য বাড়িয়ে ১৭ হাজার ৮০৭ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়।
দ্বিতীয়বারের মত সংশোধিত প্রকল্পটির ব্যয় দাঁড়াল ২৪ হাজার ৩৮১ কোটি টাকা। এক তৃতীয়াংশের বেশি ব্যয় বৃদ্ধির কারণ ব্যাখ্যা না করে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ব্যয় বৃদ্ধির কারণ ‘টেকনিক্যাল’ এবং তিনি এ বিষয়ে পুরোপুরি ‘অবগত’ নন।তিনি জানান, অতিরিক্ত এই অর্থ জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) ঋণ হিসেবে দেবে সরকারকে।
সংশোধিত দ্বিতীয় প্রকল্পটি হল সাউথ এশিয়া সাবরিজিওনাল ইকোনমিক কো-অপারেশন বা সাসেক সড়ক সংযোগ প্রকল্প-২ এর অধীনে এলেঙ্গা-হাটিকামরুল-রংপুর মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ। এই প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানো হয়েছে ৩৭৬ দশমিক ৯৯ কোটি টাকা। আওয়ামী লীগ সরকার প্রথমে ১১ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকায় প্রকল্পটি হাতে নিয়েছিল। পরে দুই দফায় ব্যয় বাড়িয়ে করা হয় ১৮ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকা। অন্তর্বর্তী সরকার নতুন করে বাড়ানোর পর নতুন ব্যয় দাঁড়াবে ১৯ হাজার ৫৬ কোটি টাকা।
নতুন প্রকল্প হিসেবে চট্টগ্রামের কালুরঘাটে কর্ণফুলী নদীর উপর একটি ‘রেল কাম রোড’ সেতু নির্মাণ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে; যার ব্যয় ধরা হয়েছে ১১ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা।
ঢাকার বাইরে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভায় নাগরিক সুযোগ সুবিধা বাড়িয়ে ‘রাজধানীকে বিকেন্দ্রীকরণ করা ও যানজট নিরসনে’ রিজিলিয়েন্ট আরবান অ্যান্ড টেরিটরিয়াল ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টও অনুমোদন হয়েছে। এর ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ হাজার ৯০১ কোটি টাকা।
সূত্র: বিডিনিউজ২৪.কম, ৭ অক্টোবর ২০২৪
এছাড়া নভেম্বরের একনেক সভায় প্রায় ৫ হাজার ৯১৫ কোটি ৯৯ টাকা ব্যয়ের ৫টি প্রকল্প অনুমোদন করেছে। এর মধ্যে সরকারি অর্থায়ন ১ হাজার ৯৫ কোটি ৯৪ লাখ টাকা, বৈদেশিক অর্থায়ন ৪ হাজার ৭৮৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা এবং সংস্থার নিজস্ব অর্থায়ন ৩২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা।
সূত্র: আজকের পত্রিকা, ২৫ নভেম্বর ২০২৪
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম তিনমাসে অনুষ্ঠিত একনেক সভা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, নতুন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে ১১ টি এবং সংশোধিত প্রকল্পে ব্যয় বাড়ানো হয়েছে দুটি প্রকল্পে৷ এছাড়া বেশকিছু প্রকল্প ব্যয় না বাড়িয়ে সংশোধন করা হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে একজন সাবেক মন্ত্রী পরিষদ সচিব(নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন, এটা বাংলাদেশের রীতি বলতে পারেন। যখনই নতুন কেউ সরকারে আসে তখন নতুন প্রকল্প গ্রহণ এবং প্রকল্পে ব্যয় বাড়ানোয় সবার আগ্রহে থাকে। এতে আসলে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আর্থিকভাবে লাভবান হয়। তাই তাদের এ বিষয়ে আগ্রহও বেশি থাকে। তবে এতে করে ক্ষতি হয় দেশের অর্থনীতির এবং দেশের মানুষের।
রাষ্ট্রের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সমূহ সংস্কার এবং দ্রুত নির্বাচন দেয়ার পরিবর্তে অন্তর্বর্তী সরকার কেনো নতুন প্রকল্প গ্রহণে এবং পুরনো প্রকল্পে ব্যয় বাড়ানোয় মনোযোগী হলেন এ প্রশ্ন তুলেছেন দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির কেন্দ্রীয় এক নেতা। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, “শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসন হটানোর পর বিএনপি সহ অপরাপর সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো আশা করেছিলো দ্রুত নির্বাচন দিবো ড.ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। কিন্তু তারা যেভাবে সংস্কারের পরিবর্তে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ আর ব্যয় বাড়াতে আগ্রহী তা আমরা ভালোভাবে নিচ্ছি না। কারণ দেশের উন্নয়ন করবে নির্বাচিত সরকার। এসব করে জনগণকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করা হলে আমরাও চুপ করে বসে থাকবো না। আপাতত আমরা ধৈর্য ধারণ করে আছি।”
ট্রু গেজেটের অনুসন্ধানে উঠে আসে সম্প্রতি নতুন বই ছাপানোর ব্যয় ও বাড়িয়েছে সরকার। পূ্র্বের তুলনায়
৭০০ কোটি টাকা ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে৷ সরকারের পক্ষ থেকে মান বাড়ানো সহ কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির কথা বলা হলেও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো অভিযোগ করছে অর্থ লোপাটের। সুত্রঃকালের কণ্ঠ
এছাড়া কমছে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) গত ২২ অক্টোবর পূর্বাভাস দিয়ে বলেছে, চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হবে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ। এর আগে বিশ্বব্যাংক বলেছে, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও সাম্প্রতিক বন্যার কারণে এই অর্থবছর শেষে দেশের প্রবৃদ্ধি কমে হবে ৪ শতাংশ। এ ছাড়া এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) গত সেপ্টেম্বর মাসে ৫ দশমিক ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছে। সূত্রঃ প্রথম আলো
সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, একদিকে দেশের অর্থনীতি ক্রমবর্ধমান খারাপের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, অন্যদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতাও চলছে৷ পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজারমূল্য। সংকটে পড়েছে দেশের নিম্ন ও মধ্য আয়ের পরিবারগুলো। এ অবস্থায় সংস্কারের চেয়ে নতুন প্রকল্প গ্রহণ এবং পুরনো প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানোর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে বিভিন্ন মহল। এছাড়া অসন্তোষ রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের সুনির্দিষ্ট মেয়াদ ঘোষনার এবং তাগিদ রয়েছে দ্রুত নির্বাচন আয়োজনে।