নেতৃত্বহীন ঢাবি ছাত্রলীগ এক বছর ধরে, ডাকসু নিয়ে নেই প্রস্তুতি

ঢাবি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ছন্নছাড়া এবং দিশাহীন বলে মনে হয়েছে। ৫ আগস্টের পর এখন পর্যন্ত ৬০ জনের অধিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ের ছাত্রলীগের নেতাকর্মী কারাবন্দি এবং চারশতাধিক বর্তমান সাবেক শিক্ষার্থী মামলার আসামি, ১২৮ জন বহিস্কার হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, এর বাইরে হাজারের অধিক শিক্ষার্থী ক্লাস পরীক্ষায় অংশ নিতে পারছেন না ছাত্রলীগ সম্পৃক্ততার কারণে।  ছাত্রলীগ নেতাদের যাদের পরিবার আর্থিকভাবে স্বচ্ছল তাদের  অনেকে ইতিমধ্যে বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন, অন্যদিকে যারা দেশে আছেন তারা আর্থিক এবং মানসিকভাবে মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন।

CrackPlatoon
6 Min Read

 

বাংলাদেশ ছাত্রলীগের এক নম্বর ইউনিট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ, গত এক বছর ধরে কার্যত নেতৃত্বহীন। ২০২৪ সালের আগস্ট পরবর্তী ভয়াবহ রাজনৈতিক অস্থিরতা ও দমন-পীড়নের প্রেক্ষাপটে সংগঠনের নেতৃত্ব ছিটকে পড়েন। সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত ঢাকা বিমানবন্দরে গ্রেফতার হন ৬ আগস্ট, আর সভাপতি মাজহারুল কবির শয়ন নেপাল হয়ে বর্তমানে যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন। ৫ আগস্টের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন ধরণের মিছিল আয়োজন করতে পারেনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ। 

ঢাবি ছাত্রলীগের একাধিক নেতাকর্মীর সাথে আলাপচারিতায় ঢাবি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ছন্নছাড়া এবং দিশাহীন বলে মনে হয়েছে। ৫ আগস্টের পর এখন পর্যন্ত ৬০ জনের অধিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ের ছাত্রলীগের নেতাকর্মী কারাবন্দি এবং চারশতাধিক বর্তমান সাবেক শিক্ষার্থী মামলার আসামি, ১২৮ জন বহিস্কার হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, এর বাইরে হাজারের অধিক শিক্ষার্থী ক্লাস পরীক্ষায় অংশ নিতে পারছেন না ছাত্রলীগ সম্পৃক্ততার কারণে।  ছাত্রলীগ নেতাদের যাদের পরিবার আর্থিকভাবে স্বচ্ছল তাদের  অনেকে ইতিমধ্যে বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন, অন্যদিকে যারা দেশে আছেন তারা আর্থিক এবং মানসিকভাবে মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন। তবে একাধিক নেতা জানিয়েছেন   বিদেশ যাওয়ার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তারা বিদেশ যাচ্ছেন না , রাজনীতি করার সিদ্ধান্তে তারা অটল যত ঝড় বয়ে যাক তাদের উপর দিয়ে। কিন্তু তারা চান তাদের রাজনীতিতে টিকে থাকতে । আর্থিক,মানসিক এবং রাজনৈতিক সমর্থন  চান দলের হাইকমান্ড থেকে,কিন্তু সেটি পাচ্ছেন না, সমর্থন যা পাচ্ছেন সেটি প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে তাদের কাছে কয়েকটি প্রশ্ন রাখেন ট্রু গেজেট-এর  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়  প্রতিনিধি।বিশ্ববিদ্যালয় ও হল শাখার বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে যুক্ত থাকলেও নিরাপত্তার কারণে কেউ নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।

সাংগঠনিক কার্যক্রমে স্থবিরতা

ঢাবি ছাত্রলীগের এক উপ-সম্পাদক হতাশার সুরে বলেন,
“ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ এখন ইউনিট হিসেবে কার্যত অকার্যকর। কেন্দ্রীয় কর্মসূচিতে কয়েকজন অংশ নিলেও সংগঠনের নিজস্ব কোনো সাংগঠনিক কর্মসূচি নেই। অনেকেই মামলা ও নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে আত্মগোপনে। অনলাইনে কিছু কার্যক্রম চালালেও তা সংগঠনের কাঠামোগত শক্তির পরিচায়ক নয়।”

তিনি আরও জানান, “সৈকত ভাই গ্রেফতারের পর থেকে আমরা অভিভাবকহীন। সভাপতি শয়ন ভাই প্রায় এক বছর ধরে কোনো যোগাযোগ রাখছেন না। ১২ মাসে একবার মাত্র একটি জুম মিটিংয়ে অংশ নিলেও আর কোনো দিকনির্দেশনা দেননি।”

একাধিক  বিশ্ববিদ্যালয়ে পদধারী   নেতা বলেন, “বর্তমান বাস্তবতায় ঢাবি ছাত্রলীগ কার্যত ছিন্নভিন্ন। কিছু প্রোগ্রাম অনলাইনে হলেও সাংগঠনিক কাঠামো বা নেতৃত্ব বলে কিছু নেই।”

হতাশ তৃণমূল, নেই দিকনির্দেশনা

এক হল শাখার প্রার্থী বলেন,

“ঢাবিতে এখনও অনেক ডেডিকেটেড কর্মী আছে, কিন্তু তাদের সংঘবদ্ধ করতে একজন ক্যারিশম্যাটিক নেতার প্রয়োজন। অনেকেই রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছেন বা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন।”

কেন্দ্রীয় সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদকের পক্ষ থেকে খোঁজখবর নেওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন,


“বিশেষভাবে যাদের অনুসারী, কেবল তাদের সঙ্গেই যোগাযোগ হয়। সংগঠনের সমষ্টিগত নেতৃত্ব নেই, কেউ নেই যে কর্মসূচির ডাক দিলে সকলে একযোগে রাজপথে নামবে।”

আরেকজন নেতার হতাশা,


“সৈকত ভাইয়ের অনুসারীদের আজ কেউই খোঁজ নেয় না। ইনান ভাই বা সাদ্দাম ভাই কেবল নিজস্ব কর্মীদের খোঁজখবর রাখছেন। শয়ন ভাই জীবিত আছেন নাকি—সেটাও নিশ্চিত নই। তিনি নেতাকর্মীদের সাথে একেবারেই যোগাযোগ করেন না, তিনি তার কর্মীদের ও ভাল করে চেনেন না ”

ডাকসু নিয়ে প্রস্তুতি নেই

ডাকসু নির্বাচন ঘিরে কোনো প্রস্তুতি আছে কিনা জানতে চাইলে বেশিরভাগ নেতাই স্পষ্টভাবে জানান,

“ডাকসু নিয়ে ঢাবি ছাত্রলীগের কোনো আলোচনা চলছে না।”

একজন সহ-সম্পাদক বলেন, “ডাকসু আমাদের জন্য এখন বিলাসিতা। ক্যাম্পাসেই তো ঢুকতে পারছি না।”

আরেক নেতা আশঙ্কা করে বলেন, “জামাতপন্থী প্রশাসন ছাত্রলীগকে অংশ নিতে দেবে না বলেই আশঙ্কা করি। তবে তফসিল ঘোষণার পর কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে অনেক কিছু।”

ঢাবির একাধিক শিক্ষার্থী জানিয়েছেন  ছাত্রলীগের অনেক ভোট আছে ঢাকা বিশ্বদিদ্যালয়ে, গত এক বছরে সমন্বয়কদের দুর্নীতি এবং প্রভাবে ক্যাম্পাসের অরাজনৈতিক শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগ নিয়ে আগের মত নেতিবাচক ইমেজ নেই। ভালো প্রার্থী দিতে পারলে ছাত্রলীগের অনেকে বেরিয়ে আসবে হল ডাকসু এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে  ‘ ।

আইনি ও আর্থিক সহায়তা—প্রায় নেই বললেই চলে

১৬ জুলাইয়ের পর কোটা আন্দোলনের সময় ২৬১টি রুমে ভাঙচুর ও লুটপাট চালানোর অভিযোগ পাওয়া যায়। এতে ঢাবি ছাত্রলীগের বহু নেতাকর্মী নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন।

একজন নেতা জানান,

“বহু কর্মী এখনো জেলে, কেউ জামিনে বের হলেও পরিবারে ফিরতে পারছে না। মানসিক এবং আর্থিক অবস্থা শোচনীয়। অনেকে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগও করতে পারছে না।”

একাধিক সূত্র জানায়,

“জেল পিসিতে মাসে নামমাত্র কিছু টাকা পাঠানো হয়। কিছু আইনি সহায়তা থাকলেও তা অপর্যাপ্ত এবং সিনিয়র আইনজীবীরা মামলা লড়ছেন না, ফলে জামিন পেতেও দেরি হচ্ছে।”

এক হল প্রার্থী বলেন,
“কারাবন্দী, বহিষ্কৃত বা মামলার আসামি প্রায় এক হাজারের বেশি নেতাকর্মী মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন।”

নতুন নেতৃত্বের জোর দাবি

বেশিরভাগ নেতাকর্মী মনে করেন, ঢাবি ছাত্রলীগকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে নতুন, সক্রিয় এবং রাজপথে পরীক্ষিত নেতৃত্ব জরুরি।


একজন উপ সম্পাদক জানান,


“বর্তমান সভাপতি পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় আর সাধারণ সম্পাদক জেলে। এখন ভারপ্রাপ্ত দিয়ে নয়, নতুন কাউকে দায়িত্ব দিয়ে কমিটি গঠন করতে হবে। যারা সম্ভাব্য ভারপ্রাপ্ত হতে পারে, তাদের রাজনৈতিক দক্ষতা নেই, জনবিচ্ছিন্ন। এতে সংগঠন আরও দুর্বল হবে।” 

রাজপথে একজন সক্রিয় নেতা বলেন,

“একজন সঠিক নেতা ছাড়া সংগঠনকে ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব নয়। ইনান-সাদ্দাম শুধু নিজের অনুসারীদের খোঁজ নেয়, বাকিরা কী করবে?”

তবে সাদ্দাম-ইনানের একাধিক অনুসারী জানিয়েছেন

তারা তাদের অনুসারীদের ও ঠিকঠাক খোঁজ রাখেন না

ঢাবি ছাত্রলীগ সভাপতি মাজহারুল কবির শয়ন ও
সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ বর্তমানে এক ভয়াবহ নেতৃত্বশূন্যতা ও সাংগঠনিক শূন্যতার মধ্য দিয়ে সময় পার করছে। মামলা, গ্রেফতার, বহিষ্কার, ও রাজনৈতিক কোণঠাসার শিকার এই ইউনিটের নেতাকর্মীরা মানবেতর জীবনযাপন করলেও অনেকে এখনও রাজনীতি করার প্রত্যয় থেকে পিছু হটেননি। তাদের প্রধান দাবি দলীয় হাইকমান্ড যেন দ্রুত সাহসী, দক্ষ ও রাজপথে পরীক্ষিত নেতৃত্ব নির্বাচনের মাধ্যমে ঢাবি ছাত্রলীগকে পুনরায় সংগঠিত করে।

error: Content is protected !!