৫ আগস্টের ক্ষমতার পটপরিবর্তনের প্রায় এক বছর পার হতে চলেছে। কিন্তু ‘পরিবর্তনের আলোকবর্তিকা’ হাতে নিয়ে আগত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সেই ‘সংস্কারের প্রদীপ’ অনেক আগেই নিভে গেছে। দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি, সামাজিক স্থিতিশীলতার ভাঙন এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর নির্লিপ্ততায় আজ কার্যত এক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। অথচ চারপাশে প্রয়োজনীয় সকল সুযোগ-সুবিধা বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও সরকার কেন একটি সুন্দর ও স্থিতিশীল রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যর্থ, সে প্রশ্ন এখন জরুরি।
দেশের ইতিহাসে এই প্রথম প্রায় সকল রাজনৈতিক দলের প্রত্যক্ষ সমর্থন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রতিরক্ষা বাহিনীর সহযোগিতা সত্ত্বেও কোনো সরকার এতটা ব্যর্থতা দেখিয়েছে। এ এক নজিরবিহীন ঘটনা।
সরকারের এই ব্যর্থতার মূল কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে প্রথমেই বলতে হয়—যে প্রদীপ নিজেই জ্বলতে চায় না, তার জন্য হাজার প্রদীপ জ্বালালেও অন্ধকার দূর হয় না। দেশে চলমান চাঁদাবাজি, লুটপাট, চুরি-ছিনতাই, খুন—এসব থামাতে সরকারের কোনো আন্তরিকতা আছে বলেই মনে হয় না। ক্রমবর্ধমান জন-অসন্তোষের পরেও তারা কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়নি। বরং পুলিশকে নানা ভয় দেখিয়ে কিংবা অপদস্থ করে কার্যত পঙ্গু করে রাখা হয়েছে। সেনাবাহিনী মাঠে থাকলেও তাদের ভূমিকা নিধিরাম সর্দারের মতো। কোনো ঘটনা ঘটে যাওয়ার ঘণ্টা কয়েক পরে তারা উপস্থিত হন, তাও কেবল ‘পরিদর্শনের’ জন্য। এ যেন পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার নয়, অস্থিরতা টিকিয়ে রাখার এক নীরব ইচ্ছা।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, সরকার নিজেই কেন দেশের স্থিতিশীলতা চায় না? তার পেছনে থাকা কারণগুলো আমাদের বোঝা দরকার।
সরকারের সব কর্মকাণ্ডে যে দুটি গোষ্ঠীর আগ্রহ ও সমর্থন সর্বাধিক তা হলো—জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। কারণ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলাতন্ত্র মূলত জামায়াতঘেঁষা। যদিও মাঝে মধ্যে সরকারবিরোধী মন্তব্য তারা করে থাকে, তা নিছক লোকদেখানো। বাস্তবে এরা নির্বাচনপ্রক্রিয়ার বিপক্ষে এবং গণপরিষদ, অনুপাতিক নির্বাচন, দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রীর আলাদা হওয়ার মত সংস্কার এজেন্ডায় সরব।
সরকার জানে, নির্বাচন ছাড়া তারা বেশিদিন ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবে না। আবার নির্বাচন দিলে এনসিপি-জামায়াত ক্ষমতায় যাবে না। তাই তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সরকারকে তারা ব্যবহার করছে। সরকারেরও এই সুযোগে সময়ক্ষেপণ করে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করার সুযোগ তৈরি হয়। ফলে, নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার পরীক্ষিত কৌশল হিসেবে দেশজুড়ে নৈরাজ্য, চাঁদাবাজি, খুনোখুনির পরিস্থিতি অব্যাহত রাখা হচ্ছে।
আর এই কর্মকাণ্ডগুলো কারা করছে? এনসিপি-জামায়াতের মূল প্রতিপক্ষ বিএনপির নেতাকর্মীরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এদের কোনো বাধা দিচ্ছে না, কারণ সরকার চায় জনগণের চোখে বিএনপির রাজনৈতিক ইমেজকে ধ্বংস করতে। এতে এনসিপি-জামায়াতেরও লাভ—একদিকে প্রতিপক্ষ দুর্বল, অন্যদিকে নির্বাচন নিয়ে কালক্ষেপণের সুযোগও তৈরি।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিএনপি এই ফাঁদ বুঝে উঠতে পারছে না। নেতাকর্মীদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা, দায়িত্বহীন আচরণ এবং সাময়িক সুবিধাভোগের মোহে অনেকে অস্থিরতা বজায় রাখতে চাচ্ছেন। এতে করে জামায়াত ও এনসিপি এক ঢিলে দুই পাখি মারার সুযোগ পাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের একচেটিয়া প্রচারের ফলে, বিএনপির এসব কর্মকাণ্ড অতিরঞ্জিত করে তুলে ধরা হচ্ছে, যা একদিকে তাদের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করছে এবং অন্যদিকে নির্বাচন বিলম্বের ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো—বিএনপিকে আওয়ামী লীগের সমতুল্যে দেখানোর আপ্রাণ প্রচেষ্টা। এনসিপি-জামায়াত চায় জনগণের আওয়ামী বিরোধী ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের বিকল্প শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে। কিন্তু যখন তারা দেখলো জনগণ তাদের গ্রহণ করছে না, তখন তারা সেই ক্ষোভকে বিএনপির বিরুদ্ধে ঘুরিয়ে দিতে উদ্যোগী হলো। এতে সহায়ক হয়েছে জামায়াতের আগের কর্মীরা, যারা খোলস পালটে নতুন নাম ও পরিচয়ে রাজনৈতিক মঞ্চে এসেছে। তারা এখন বিএনপির বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে, এবং একসঙ্গে বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে এক পাল্লায় ফেলে—যেমন বলা হয়, “নৌকা ও ধানের শীষ, দুই সাপের এক বিষ”।
প্রশ্ন উঠতে পারে—এনসিপি ও জামায়াত জানে যে তারা ক্ষমতায় যেতে পারবে না, তবুও তারা কেন এমন বিভ্রান্তিমূলক কর্মকাণ্ড করছে? এর সহজ উত্তর হলো—বিভ্রান্ত জনগোষ্ঠীকে বিপথে পরিচালিত করা পৃথিবীর সবচেয়ে সহজ কাজ। তারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ক্ষুদ্র রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে এই কাজটা সহজেই করতে পারছে। তারা সফল হলে গণতন্ত্রের গতিপথ কয়েক যুগ পিছিয়ে যাবে এবং দায়হীন, অগণতান্ত্রিক সরকারগুলোই ক্ষমতার নিয়ামক হয়ে থাকবে।
এখানে দেশের বামপন্থী রাজনৈতিক শক্তির ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলা দরকার। বাস্তবতার বিচারে, বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে বাম দলগুলোর পক্ষে নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন সম্ভব নয়। তবে দেশের শিক্ষিত ও প্রগতিশীল শ্রেণির বড় অংশই তাদের সমর্থক। কিন্তু বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, এই শ্রেণির মানুষ মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত—তাদের দমন-পীড়নের শিকার হতে হচ্ছে, ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর হামলার মুখে পড়তে হচ্ছে। বর্তমান পশ্চিমা মদদপুষ্ট সরকার তাদের আগের মতো নিরাপত্তা দিতে পারছে না। আর বিএনপিও তাদের পক্ষে কোনো শক্ত অবস্থান নিচ্ছে না ধর্মীয় ভোট হারানোর ভয়ে।
ফলে মুক্তচিন্তার অগ্রযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে, এবং বামপন্থীদের মধ্যে একধরনের অনিশ্চয়তা ও দ্বিধা কাজ করছে। একদিকে, ৫ আগস্টের ঘটনার সময় তাদের অগ্রণী ভূমিকার জন্য তারা আত্মগ্লানিতে ভুগছে, অন্যদিকে নিরাপত্তাহীনতা তাদের কলম বন্ধ করে রেখেছে। তবে বিশ্বাস করি, সময়ের সঙ্গে তারা আবার কলম ধরবে এবং সত্যের পক্ষে সোচ্চার হবে।
সবশেষে, বলা যায়—বাংলাদেশের প্রগতিশীল রাজনীতিতে যারা ধারাবাহিকভাবে মুক্তচিন্তার পথে বাধা হয়নি, তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগ একটি নাম। কিন্তু রাজনৈতিক বাস্তবতায় আজ সবই বিতর্কের মুখে, আর জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি যেন প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে নতুন করে আত্মবিশ্লেষণ ও কার্যকর রাজনৈতিক উদ্যোগ নেওয়ার সময় এখনই।