আদানি বিদ্যুৎ চুক্তি: দিল্লী না ঢাকা? কার খরচে চলছে বিদ্যুৎ বিলের রাজনীতি

শেখ হাসিনা সরকার ১ বছরে পরিশোধ করতে পেরেছিল ১১২১.২৮ মিলিয়ন ডলার। ইউনুস সরকার একই সময়ে পরিশোধ করেছে মাত্র ৪২৫ মিলিয়ন ডলার (জানুয়ারি – মে), এরপর জুলাইতে দেয় ৪৩৭ মিলিয়ন। অর্থাৎ প্রায় এক বছরেও বকেয়া পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে এখন অতিরিক্ত বিলম্ব মাশুল গুণতে হচ্ছে।

Truegazette
4 Min Read

রিপোর্টার: (The Night Owl)
প্রকাশকাল: জুলাই ৪, ২০২৫

২০০৬ সালে যখন বিএনপি-জামাত জোট ক্ষমতায় ছিল, তখন দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল মাত্র ৩,৭৮২ মেগাওয়াট এবং মাত্র ২৮% জনগণ বিদ্যুৎ সুবিধা পেত। অথচ ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ তা দাঁড়ায় ২৫,২২৭ মেগাওয়াটে এবং প্রায় ১০০% জনগণ বিদ্যুতের আওতায় আসে। এই প্রবৃদ্ধির পেছনে শেখ হাসিনার সরকারের বড় অবদান থাকলেও, এসময়ই একটি বিতর্কিত চুক্তির সূত্রপাত ঘটে—আদানি বিদ্যুৎ চুক্তি।

চুক্তির শুরু: ব্যাকগ্রাউন্ড

২০১৭ সালে ভারতীয় কর্পোরেট জায়ান্ট আদানি পাওয়ারের সঙ্গে চুক্তি করে পিডিবি। ২ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে আদানি তৈরি করে একটি ১৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র, যার ৮০০ মেগাওয়াটের দুটি ইউনিট ২০২৩ সালের এপ্রিল ও জুনে উৎপাদনে আসে। উৎপাদনের শুরুতে দাবি করা হয়, এই কেন্দ্র থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের খরচ হবে ১৫ টাকা, যার মধ্যে ক্যাপাসিটি চার্জ রয়েছে ৪.২৪ ইউএস সেন্ট।

বাস্তবতা ও হিসাব

২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত তিন মাসে আদানি উৎপাদন করে ১৫৯.৮০ কোটি ইউনিট বিদ্যুৎ। প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ হয় ১৪.০২ টাকা।
এই সময়ে শেখ হাসিনার সরকার আদানিকে পরিশোধ করে ১,১২১.২৮ মিলিয়ন ডলার (জুলাই ২০২৩ – মে ২০২৪), যার গড় দাঁড়ায় মাসে ৯৩.৪৪ মিলিয়ন ডলার।

ক্ষমতার পালাবদল ও দায়ভার

আগস্ট ২০২৪-এ শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর নতুন সরকার গঠন করেন ইউনুস আলি ভুট্টো নেতৃত্বাধীন দল। শুরু থেকেই তারা আদানি চুক্তিকে ‘দালালি চুক্তি’ আখ্যা দিয়ে বাতিলের ঘোষণা দেন। কিন্তু বাস্তবে আদানিকে অর্থ পরিশোধ বন্ধ হয়নি। বরং ইউনুস সরকারের আমলেই আদানি পাওয়ার জানায়, বাংলাদেশের বকেয়া দাঁড়িয়েছে প্রায় ৯০০ মিলিয়ন ডলারে।

বিপিডিবি চেয়ারম্যান স্বীকার করেন, ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে মাসে ৮৫ মিলিয়ন ডলার করে পরিশোধ শুরু হলেও বকেয়া রয়ে গেছে প্রায় ৬৫০ মিলিয়ন ডলার।
হিসাব বলছে:
৯৩.৪৪ মিলিয়ন x ৯ মাস (জুন ২০২৪ – ফেব্রুয়ারি ২০২৫) = ৮৪০.৯৯ মিলিয়ন ডলার বকেয়া।
যদি ২ মাসে ৮৫ মিলিয়ন করে ১৭০ মিলিয়ন দেওয়া হয়, বাকি থাকে ≈ ৬৭০.৯৯ মিলিয়ন — যা বিপিডিবি ও আদানি উভয়ের তথ্যের সঙ্গে মিলে যায়।

আদালতের রায় ও চূড়ান্ত খরচ

২৭ এপ্রিল ২০২৫ হাইকোর্ট রায় দেয়, আদানি চুক্তি ছিল ‘নিয়মতান্ত্রিক’।
জুন ২০২৫ শেষে আদানি পাওয়ার জানায়, মোট ২ বিলিয়ন ডলারের চুক্তির মধ্যে বাংলাদেশ পরিশোধ করেছে প্রায় ১৫০০ মিলিয়ন ডলার।জুলাই ২০২৫-এ ইউনুস সরকার ৪৩৭ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করে এবং বকেয়া ১৩৬ মিলিয়ন ডলার বিলম্ব মাশুল গচ্চা দিতে হয়।

প্রশ্নের মুখে ইউনুস সরকার

শেখ হাসিনা সরকার ১ বছরে পরিশোধ করতে পেরেছিল ১১২১.২৮ মিলিয়ন ডলার।ইউনুস সরকার একই সময়ে পরিশোধ করেছে মাত্র ৪২৫ মিলিয়ন ডলার (জানুয়ারি – মে), এরপর জুলাইতে দেয় ৪৩৭ মিলিয়ন।অর্থাৎ প্রায় এক বছরেও বকেয়া পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে এখন অতিরিক্ত বিলম্ব মাশুল গুণতে হচ্ছে।

শেষ কথা

‘দিল্লী না ঢাকা, দিল্লী দিল্লী’—এই স্লোগানে রাজনীতি করা সরকারও আদানিকে সময়মতো অর্থ দিতে ব্যর্থ। পরিণামে দেশের অর্থনীতির ঘাড়ে চাপছে বিলম্ব মাশুলের বোঝা।
প্রশ্ন থেকে যায়:

  • শেখ হাসিনার সরকারের ‘দালালি’ চুক্তির দায় নিচ্ছে এখনকার ‘স্বচ্ছ’ সরকার কেন?
  • এত টাকা ছাপিয়েও পরিশোধের সামর্থ্য নেই কেন?
  • দুর্নীতি আগের সরকার করেছে, তাহলে টাকা এখন কোথায় যাচ্ছে?

বাংলাদেশের বিদ্যুৎ রাজনীতি কি আদতে দেশের হাতে, না দিল্লীর হাতে—তা এখন বিবেচনার সময়।

স্লোগান নয়, উত্তর দিন: দিল্লী না ঢাকা? নাকি সুইজারল্যান্ড?

error: Content is protected !!