রমজান সামনে রেখে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দ্রব্যমূল্য নিয়ে প্রচার চালানো হচ্ছে। ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া কয়েকটি ফটোকার্ড দাবি করছে, গত বছরের তুলনায় এ বছর নিত্যপণ্যের দাম স্থিতিশীল রয়েছে। তবে সংবাদমাধ্যমের তথ্য বলছে ভিন্ন কথা। বাজারে সরেজমিনে গেলে দেখা যাচ্ছে, দাম নিয়ে ফেসবুকের দাবি অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তবতার সঙ্গে মিলছে না।

বহুল প্রচারিত ফটোকার্ডগুলোতে বলা হয়েছে, দেশি পেঁয়াজ কেজিপ্রতি ৩৫-৪৫ টাকা, বিদেশি পেঁয়াজ ৬৫-৭৫ টাকা, চিনি ১২০ টাকা, পাঙাশ ও তেলাপিয়া ১৫০-১৮০ টাকা, ব্রয়লার মুরগি ১৮৫-১৯৫ টাকা, টমেটো ৩০-৪০ টাকা, আলু ২০-২২ টাকা, মরিচ ৩০-৪০ টাকা, ছোলা ১২০ টাকা, বেগুন ৩০-৪০ টাকা, শসা ৩০ টাকা এবং সয়াবিন তেল এক লিটারের বোতল ২০০ টাকা । কিন্তু বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বেশির ভাগ পণ্যের দাম ফটোকার্ডে দেওয়া দামের চেয়ে বেশি।

বাংলাদেশের প্রচলিত সংবাদ মাধ্যমের সংবাদ যাচাই করে আমরা সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র পাই ,গত বছরের রমজানের সময়ের তুলনায় এবার সব ধরনের চালের দাম ৬ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে,ভোজ্যতেলের দামও ১১-২০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।এখন টেলিভিশনের জানাচ্ছে দেশী পেয়াজে দাম ৪৫-৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ডেইলি স্টার ২০২২ থেকে ২০২৫ সালে দ্রুব্যমূল্যের বৃদ্ধি নিয়ে আরেকটি তুলনামূলক সংবাদ প্রকাশ করেছে ২০২৫ সালের রমজানে খেজুর,ছোলা, সয়াবিন তেল এবং ডিমের দাম সবচেয়ী বেশি সবচেয়ে বেশি পূর্ববর্তী বছরগুলোর তুলনায়।

ঢাকা পোস্ট খেজুরের দাম বৃদ্ধি নিয়ে চমকপ্রদ অনুসন্ধানী রিপোর্ট করেছে ‘কমেছে’ প্রচারণাতে খেজুরের কেজিতে বেড়েছে দেড়শ টাকা,রোজার প্রথম দিনে বাজার ঘুরে দেখা যায়, চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে প্রায় সব ধরনের খেজুরের দাম। বাজারে সবচেয়ে কম দামে বিক্রি হওয়া জাহেদী খেজুরের দাম ২০ থেকে ৪০ টাকা বেড়েছে। দাম কিছুটা কম হওয়ায় নিম্নবিত্তের ও খেটে খাওয়া মানুষের চাহিদায় থাকে এ খেজুর। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাজারে প্রতি কেজি জাহেদী খেজুর বিক্রি হচ্ছে ২৮০ থেকে ৩০০ টাকায়। যা এক সপ্তাহ আগেও বিক্রি হয়েছে ২০০ থেকে ২৬০ টাকায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী বলেন,

আওয়ামী লীগের সময় খেজুর আমদানি নিয়ন্ত্রণ করত নজরুল ইসলামের নাসা ও হাজী সেলিমের মদিনা গ্রুপ। এবার সেই সিন্ডিকেট ভেঙেছে। তবে আওয়ামী লীগের সেই জায়গাটা দখল করেছে অন্য আরেকটি রাজনৈতিক দল। যে কারণে খেজুরের দাম কমে গিয়েও সেটি আবার বেড়েছে।
ঢাকা পোস্ট জানাচ্ছে কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা গেছে, কাঁচামরিচ জাত ভেদে ৭০-৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে, যার দাম গত সপ্তাহে ছিল ৬০ টাকা। টমেটোর দামও ২৫ টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০ টাকায়। এছাড়া শিম ৬০ টাকা, লাউ ৪০-৬০ টাকা, লম্বা বেগুন ৮০ টাকা, করলা ১০০ টাকা, গাজর ৩০ টাকা কেজি দামে বিক্রি হচ্ছে। বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, লেবুর হালি (৪টি) সর্বনিম্ন দাম শুরু হচ্ছে ৫০-৬০ টাকায় (ছোট আকৃতির লেবু)। এরপর মাঝারি ধরনের লেবুর হালির দাম চাওয়া হচ্ছে ৭০-৮০ টাকা। আর বড় আকৃতির লম্বা লেবুর হালির দাম ৯০-১১০ টাকা পর্যন্ত চাওয়া হচ্ছে। এছাড়া গোল আকৃতির বড় লেবুগুলো হালির দাম ১০০-১৩০ টাকা পর্যন্ত হাঁকা হচ্ছে।

বাংলা ট্রিবিউন জানাচ্ছে দুইদিন আগে (২৬ ফেব্রুয়ারি) এই একই বাজারে রোজা উপলক্ষে চাহিদা থাকা লম্বা বেগুন বিক্রি হয়েছে ৬০ টাকা কেজিতে। কিন্তু আজকে তা বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ১২০ টাকা কেজিতে। শসা বিক্রি হয়েছে ৪০ থেকে ৬০ টাকা কেজিতে, অথচ আজকে এই শসা বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ১০০ টাকা করে। লেবুর হালিও দুদিন আগে বিক্রি হয়েছে ৬০ করে, কিন্তু আজকে মানভেদে প্রতি হালি লেবু বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকায়। তবে কেবল এসব সবজির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই মূল্যবৃদ্ধি, কয়েকটি বাদে প্রায় সব সবজির দামই দুইদিনের ব্যবধানে নতুন করে বেড়েছে। বাংলা ট্রিবিউন আরো জানাচ্ছে এক্ষেত্রে দেখা যায় গত দুইদিনের ব্যবধানে প্রতি কেজিতে দেশি মুরগির দাম বেড়েছে ৫০ টাকা। ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে ৬ টাকা, কক মুরগির দাম বেড়েছে ৩ টাকা। তবে লেয়ার মুরগির দাম কমেছে ৭-১০ টাকা। এছাড়া অন্যান্য মাংস ও মুরগির ডিমের দাম রয়েছে অপরিবর্তিত।

এদিকে কেবল মাংসের দামই বাড়েনি। বেড়েছে প্রায় সব ধরনের মাছের দামও।

মাছের বিক্রেতারা বলেন,
আমরা দুইদিন আগেও আধা কেজি (৫০০গ্রাম) ওজনের ইলিশ মাছ বিক্রি করেছি ১ হাজার থেকে ১২০০ টাকায়। আজকে সেই মাছ বিক্রি করতে হচ্ছে ১৬০০ টাকায়। আর শুধু ইলিশ মাছ না সব মাছের দামই অনেক বেড়েছে।
এদিকে বিবিসি বাংলা বলছে ক্রেতা ও বিক্রেতা, উভয় পক্ষের সাথে কথা বলে জানা গেছে যে গত প্রায় ১৫ দিন থেকে এক মাস ধরে সয়াবিন তেল নিয়ে সংকট চলছে। রমজান ঘনিয়ে আসায় এই সংকট আরও বেড়েছে বলে মনে করছেন ক্রেতারা। চাকরির সুবাদে ঢাকার বনশ্রীতে থাকেন মারিয়া আক্তার। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় দুটি সুপার শপ ঘুরেও সয়াবিন তেল পাননি বলে জানান তিনি। মিজ আক্তার বিবিসি বাংলাকে বলেন,
“তেল কেনা লাগতোই। সুপারশপে না পেয়ে অন্তত ১০টা নরমাল দোকানে খুঁজেছি, তেল নাই কারও কাছে। পরে বাধ্য হয়ে হাফ লিটার সরিষার তেল কিনে এনেছি।”
অন্যদিকে জাগো নিউজ জানাচ্ছে বরিশালে বটতলা বাজার এলাকার মুদী ব্যবসায়ী মায়ের দোয়া স্টোরের মালিক সুজন হাওলাদার বলেন, তেল কোম্পানিগুলো সয়াবিন তেলের সঙ্গে প্যাকেটজাত পোলাওয়ের চাল নিতে বাধ্য করছে। কিন্তু প্যাকেটজাত পোলাওয়ের চাল ক্রেতারা নিতে চায় না, কারণ বাজারে খোলা পোলাওয়ের চালের মান অনেক ভালো, দামও কম। যেখানে খোলা পোলাওয়ের চাল ১১৫ থেকে ১২০ টাকায় পাওয়া যায়, সেখানে ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকায় কেন ক্রেতারা প্যাকেট চাল কিনবে। পোলাওয়ের চাল ছাড়াও কোম্পানিগুলো তাদের অচল প্যাকেটজাত পণ্যগুলো তেলের সঙ্গে জোর করে ধরিয়ে দিচ্ছে। যেসব পণ্য ক্রেতারা নিতে চায় না, সেগুলো জোর করে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
এদিকে প্রথম আলো তেলের বাজারে নৈরাজ্য নিয়ে গত সপ্তাহে একই ধরণের রিপোর্ট করে
বিক্রেতারা জানান, গত নভেম্বর মাস থেকেই বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সংকট চলছে। মাঝের সময়ে সয়াবিন তেলের দাম লিটারে আট টাকা বাড়ানোর পরে সরবরাহের সংকট কিছুটা কমেছিল। তবে চলতি মাসের শুরু থেকে আবার তীব্র হয়েছে এ সংকট।বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সংকট এখনো কাটেনি। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে কয়েক দোকান ঘুরেও বোতলজাত সয়াবিন তেল কিনতে পারছেন না ক্রেতারা। আর কবে নাগাদ বাজারে সরবরাহ ঠিক হবে, সেটিও জানাতে পারছেন না বিক্রেতারা।
গতকাল প্রথম আলো আরেকটি রিপোর্ট প্রকাশ করে এই ঘটনা নিয়ে ঢাকা ও চট্টগ্রামের কয়েকটি বাজার ঘুরে গতকাল শুক্রবার দেখা গেছে, বোতলজাত সয়াবিন তেল নেই বললেই চলে। বিশেষ করে পাঁচ লিটারের বোতল পাওয়া যাচ্ছে না। কয়েক সপ্তাহ ধরেই এই সংকট চলছে।

ফলমূলের দর নিয়েও নৈরাজ্য থেমে নেই, সময় টিভি জানাচ্ছে রমজানের শুরুতেই ফলের বাজারে উত্তাপ। মাল্টা, কমলা, তরমুজ, আঙুর, আনারসের মতো রসালো ফলের দাম এক সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিপ্রতি বেড়েছে ২০-৫০ টাকা।ঢাকা পোস্ট জানাচ্ছে বাজার ঘুরে দেখা গেছে, মাল্টা, কমলা ও আপেলের দাম কেজি প্রতি ২০-৪০ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। রাজধানীর অধিকাংশ বাজারে প্রতি কেজি মাল্টা ৩০০-৩২০ টাকা, কমলা ২৭০-২৮০ টাকা, চায়না (মোটা) কমলা ৩০০-৩২০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে ফুজি জাতের আপেল বিক্রি হচ্ছে ৩১০-৩২০ টাকা কেজি দরে এবং গ্রিন ও গালা আপেল ৪২০-৪৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।আর দেশীয় ফল প্রতি পিস ডাবের দাম আগের তুলনায় ২০ থেকে ৩০ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। ছোট আকারের ডাব বিক্রি হচ্ছ ১০০-১২০ টাকায়। অন্যদিকে বড় আকারের এক পিস ডাব ১৫০-১৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে দেশীয় ফল বেল (পিস) বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১৫০ টাকায়।দাম বেড়েছে কলা ও পাকা পেঁপেরও। কলা প্রকার ভেদে হালি প্রতি বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৬০ টাকায়। যার মধ্যে একটু ভালো মানের সবরি ও সাগর কলা হালি প্রতি ৫০-৬০ টাকা ও পাহাড়ি জাতের বাংলা কলা হালি প্রতি ৪০ টাকা বিক্রি হচ্ছে।
দেশের কাঁচাবাজারে নৈরাজ্যের চূড়ায় পৌছেছে, খেজুরের দাম হতে শুরু করে ইফতার সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকটি দ্রব্যের দাম চড়া । এমনকি ফলমূল, মাছ মাংসের অস্বাভাবিক উর্ধগতিতে দেশের সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের প্রেস উইং থেকে গতকাল নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের দামের একটি তুলনামূলক মূল্যতালিকা দেওয়া হয়। তাতে দেখা যায়, গত বছরের রমজানের সময়ের তুলনায় এবার সব ধরনের চালের দাম ৬ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। ভোজ্যতেলের দামও ১১-২০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। প্রথম আলো ও তাদের রিপোর্টে বলছে এবার ও ইফতারসামগ্রীর দাম চড়া। ফেসবুকে ইউনুস সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টা নাগরিক পার্টি এবং জামায়াতে ইসলামির কর্মীরা দ্রব্যমূল্য যে ভূঁয়া প্রচারণা চালাচ্ছে সেটা রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে অপতথ্য সন্ত্রাসের আরেকটি উদাহরণ হয়ে থাকবে।
দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক উর্ধগতি লুকিয়ে ফেসবুকভিত্তিক অপপ্রচারণার মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার থেকে। বাস্তব বাজারদর বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব পণ্যের দাম গত বছরের তুলনায় বেড়েছে, বিশেষ করে চাল, তেল, ডাল, মাছ, মাংস, খেজুর ও ফলমূলের দাম সাধারণ ভোক্তাদের নাগালের বাইরে চলে গেছে। অথচ একটি মহল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক দেখানোর চেষ্টা করছে।
এই ধরনের অপপ্রচার শুধু জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে না, বরং নীতিনির্ধারকদের জন্যও ভুল বার্তা দেয়, যা নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। সঠিক তথ্য প্রচার ও বাজার পরিস্থিতি মনিটরিং নিশ্চিত করতে হলে সরকার, গণমাধ্যম ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। জনগণকেও যাচাই-বাছাই ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের তথ্য বিশ্বাস না করে নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে বাজারদর সম্পর্কে সচেতন হতে হবে।