শিল্প, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে মৌলবাদের কালো থাবা, কোন পথে যাচ্ছে বাংলাদেশ?

এভাবে একের পর এক যখন শিল্প, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বাধা দেয়া হচ্ছে, নারী ফুটবল বন্ধে হামলা করা হচ্ছে, শিল্পীদের কাজে বাধা দেয়া হচ্ছে তখন প্রশ্ন উঠে রাষ্ট্র বা সরকার কী করছে! বাধা প্রদান কিংবা হামলার এসব ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সরকার বা প্রশাসন এ ধরনের ঘটনায় নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। বইমেলায় প্রকাশকের উপর পুলিশের উপস্থিতিতেই হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব কাজে জড়িতদের গ্রেফতারেও তোড়জোড় দেখা যায়নি সরকারের পক্ষ থেকে।

হায়দার আহমেদ
16 Min Read

সম্প্রতি বাংলাদেশের শিল্প ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এবং মুক্তবুদ্ধি চর্চার উপর প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো বাধা প্রদানের ঘটনা ঘটছে। তৌহিদি জনতার নামে এসব ঘটনার নেপথ্যে রয়েছে উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদীরা। এ অবস্থায় হুমকিতে পড়েছে দেশের সাংস্কৃতিক ও মুক্তিবুদ্ধির চর্চা। মৌলবাদের কালো থাবা কী তবে গ্রাস করবে বাংলাদেশের শিল্প, সংস্কৃতি। কোন পথে বাংলাদেশ এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে ‘ট্রু গেজেট’র অনুসন্ধানী দল।

গত বছরের ৫ আগস্ট ব্যাপক জন বিক্ষোভের কারণে ক্ষমতাচ্যুত হয় ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে দেশ শাসন করা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার। মূলত ছাত্র ও তরুণদের নেতৃত্বে এ আন্দোলন সংগঠিত হয়। যাদের ইশতেহার ছিলো রাষ্ট্র সংস্কার এবং নতুন বাংলাদেশ বিনিমার্ণ করা। স্বাধীনতার পর থেকে বারবার বিভিন্ন সরকারের নানা অপশাসনে অতিষ্ট বাংলাদেশীরা ভেবেছিলো এবার তবে পরিবর্তন হবে সবকিছু। তৈরি হবে সবার সম অধিকার নিশ্চিতের নূতন বাংলাদেশ। কিন্তু নানা ঘটনায় গত ছয় মাসে ফিকে হয়ে গিয়েছে মানুষের সে স্বপ্ন। উচ্চ খাদ্য মূল্যস্ফীতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি, ডলার সংকট, মব সংস্কৃতি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট, বিরোধীমতের উপর হামলা ও তাদের সম্পদ লুটপাট, ভাঙচুর, গায়েবি মামলা, গণগ্রেফতার, সুফি সাধকদের মাজারে হামলা, শিল্প, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বাধা দেয়া, মুক্ত বুদ্ধির চর্চায় বাধা দেয়া, স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধ, সাংবাদিকদের উপর হামলা এবং উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদ মাথা ছাড়া দিয়ে উঠেছে। যারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিগত সরকারের আমলে এমন আস্ফালন দেখাতে পারেনি বা দেখালেও সরকার তার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলো বলে মনে করছেন ভুক্তভোগী মানুষেরা। আন্দোলন করে তারা প্রতারিত হয়েছেন কিনা ইতোমধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে জনমনে। এ বিষয়ে ফেসবুকেও লেখালেখি করতে দেখা যাচ্ছে অনেককে।

আমাদের এ রিপোর্টে সরকার পরিবর্তনে পর শিল্প, সংস্কৃতি, মুক্ত বুদ্ধির চর্চা কিংবা নারীদের খেলাধুলার মতো বিষয়ে ধর্মীয় মৌলবাদীদের থেকে যেসব বাঁধাপ্রদানের ঘটনা ঘটেছে তা এবং সংস্কৃতির অঙ্গনের মানুষদের প্রতিক্রিয়া কিংবা সরকারের গৃহীত প্রদক্ষেপ নিয়ে অনুসন্ধানের চেষ্টা করা হয়েছে। সংস্কৃতি অঙ্গনে যেসব বাঁধা এসেছে তা উল্লেখ করা প্রয়োজন-

‘সাংস্কৃতিক অঙ্গনে’ উগ্রবাদের কালো থাবা:

গত ২ নভেম্বর, ২০২৪ রাজধানীতে শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় একদল ব্যক্তির বিক্ষোভের মুখে ‘নিত্যপুরাণ’ নাটকের প্রদর্শনী মাঝপথে বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন আয়োজকরা।

শনিবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে বিক্ষোভকারীরা শিল্পকলা একাডেমির গেইট ভেঙে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করলে নাটকটির মঞ্চায়ন বন্ধ করা হয় বলে নাট্যকলা ও চলচ্চিত্র বিভাগের পরিচালক ফয়েজ জহির জানিয়েছেন। সূত্রঃ বাংলানিউজ

গত ১৯ অক্টোবর ২০২৪, ঢাকার হাতিরঝিলের অ্যাম্ফিথিয়েটারে ‘গণজোয়ার’ কনসার্টের ঘোষণা দিয়েছিল আয়োজক প্রতিষ্ঠান ম্যাভিক্স গ্লোবাল। অনুষ্ঠানের আগে ভেন্যু পরিবর্তনের কথা জানায় আয়োজক প্রতিষ্ঠান। জানা যায়, হাতিরঝিলের অ্যাম্ফিথিয়েটার নয়, কনসার্টটি হবে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে। এতে পারফর্ম করার কথা ছিল ব্যান্ড নেমেসিস, ক্রিপটিক ফেইট, অ্যাভয়েড রাফা, বে অব বেঙ্গল, কাকতাল, কনক্লুশনসহ আরও অনেকে। কিন্তু অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলে পণ্ড হয় আয়োজন। এক ফেসবুক পোস্টে এমনটাই জানিয়েছেন ব্যান্ড নেমেসিসের জোহাদ রোজা চৌধুরী।জোহাদ তাঁর ফেসবুকে লিখেছেন,

‘আজকের কনসার্ট ভালোই হচ্ছিল। ক্রিপটিক ফেইট স্টেজে, হঠাৎ করে ২০-৩০ জনের দল মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ফটক ভেঙে ভেতরে ঢুকে যায়। তারপর কী হলো, আপনারা বুঝতেই পারছেন। কনসার্টটি বাতিল হলে গেল। আমরা নেমেসিস, অ্যাভয়েড রাফা শোতে পারফর্ম করতে পারলাম না।’

এর আগেও একাধিক কনসার্টে এমন ঘটনা ঘটেছে। তাই প্রশ্ন রেখে সেসব ঘটনার কথা উল্লেখ করে জোহাদ ফেসবুকে লিখেছেন,

‘বিগত বেশ কয়েকটি কনসার্টে এই একটি জিনিসই হচ্ছে। এরা কারা? এরা কি আসলেই গান শুনতে আসে নাকি খুবই পূর্বপরিকল্পনা করে শো পণ্ড করতে কর্মকাণ্ড চালায়?’

ব্যান্ড নেমেসিসের জোহাদ রোজা চৌধুরী

গত ২ নভেম্বর, ২০২৪ নিজের শহর চট্টগ্রামে বাধার মুখে পড়ে শোরুম উদ্বোধন করতে পারেননি জনপ্রিয় অভিনেত্রী মেহজাবীন চৌধুরী। আজ দুপুরে চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজারে ‘খুকি লাইফস্টাইল’ নামে একটি শোরুমের উদ্বোধনের কথা ছিল তার। তবে সব কিছু ঠিক থাকলেও নির্ধারিত সময়ে যেতে পারেননি শোরুম উদ্বোধন করতে। খুকি লাইফস্টাইলের রিয়াজউদ্দিন বাজারের শোরুমের ম্যানেজার ইমদাদুল ইসলাম জানান, ব্যক্তিগত কারণে তিনি আসেনি।

তবে তাকে না নিয়ে আসার জন্য রিয়াজউদ্দিন বাজারের ব্যবসায়ীদের চাপ ছিল বলে জানিয়েছে আরেকটি সূত্র। মেহজাবীন চৌধুরী যাওয়ার আগেই তাকে নিয়ে দোকান উদ্বোধনের সিদ্ধান্ত থেকে সরে না এলে প্রতিরোধ গড়ে তোলার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয় ‘রিয়াজউদ্দিন বাজার সর্বস্তরের ব্যবসায়ী ও তৌহিদি তাওহিদি জনতার ব্যানারে।

২৫ জানুয়ারি, ২০২৫ টাঙ্গাইলের কালিহাতি উপজেলায় একটি শোরুম উদ্ধোধনের কথা ছিল চিত্রনায়িকার পরীমনির। গত ১৫ দিন ধরে মাইকিং করে এ খবর প্রচার করে ‘অথেনটিক প্রোডাক্ট হারল্যানে স্টোর’ নামের সেই শোরুম কর্তৃপক্ষ।

তবে স্থানীয় তৌহিদী জনতার মধ্যে এ নিয়ে শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা। হেফাজতে ইসলামসহ বেশকিছু স্থানীয় সংগঠন পরীমনির আগমন ঠেকানোর জন্য প্রচারণা শুরু করে। একপর্যায়ে চাপের মুখে শোরুমের মালিক মীর মাসুদ রানা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি স্থগিত করতে বাধ্য হন।

গত ২৯ জানুয়ারি, ২০২৫  ঢাকার কামরাঙ্গীরচর এলাকায় একটি রেস্টুরেন্ট উদ্বোধনের কথা ছিল চিত্রনায়িকা অপু বিশ্বাসের। সবকিছু ঠিকঠাক হওয়ার পর সেই রেস্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষ ফেসবুকে প্রচারণা চালায়। রেস্টুরেন্ট উদ্বোধনে যাচ্ছেন অপু বিশ্বাস, এমন খবর ছড়িয়ে পড়ার পর সেখানকার স্থানীয় কিছু মানুষ ফেসবুকে লেখালেখি করেন। প্রতিবাদ জানান। বিষয়টি রেস্টুরেন্ট স্বত্বাধিকারীদের হয়ে কামরাঙ্গীরচর থানা পর্যন্ত গড়ায়। এরপর চিত্রনায়িকা অপু বিশ্বাসকে দিয়ে উদ্বোধনের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন রেস্টুরেন্ট–সংশ্লিষ্টরা। প্রথম আলোকে খবরটি নিশ্চিত করেন কামরাঙ্গীরচর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আমীরুল ইসলাম।

গত ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫ সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়ার পরও ‘একদল ব্যক্তির হুমকির মুখে’ স্থগিত হলো ‘ঢাকা মহানগর নাট্য উৎসব’। নিরাপত্তা শঙ্কার কারণে উৎসব স্থগিতে বাধ্য হওয়ার কথা জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর নাট্য পর্ষদের আহ্বায়ক ঠান্ডু রায়হান। তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন,

“অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে, সকলের নিরাপত্তার কথা ভেবে আমাদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও ভালোবাসায় আয়োজন করা প্রাণের নাট্যোৎসব আপাতত স্থগিত ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছি।”

হুমকির মুখে স্থগিত ঢাকা মহানগর নাট্যোৎসব

২০ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫ তোপের মুখে দোকান উদ্বোধন অনুষ্ঠান ত্যাগ করলেন চিত্রনায়িকা বুবলী। ভুয়া ভুয়া স্লোগানের মুখে অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন এই অভিনেত্রী। ভিডিও দেখুন এখানে

একই অনুষ্ঠানে উদ্যোক্তা  এবং ব্র্যান্ড প্রোমোটর বারিশ হক উপস্থিত ছিলেন। তবে অনুষ্ঠান চলাকালীন সময়ে উপস্থিত জনতা হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে ওঠে এবং ‘ভুয়া ভুয়া’ স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে পরিবেশ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আগে বুবলী, বারিশ হক এবং তার স্বামী সীমান্ত রহমান দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন।

২০ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫ বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চে সাংস্কৃতিক সংগঠন চারুকলা সংসদের (ববিচাস) আয়োজনে কনসার্ট একদল শিক্ষার্থীর বাধায় পণ্ড হয়েছে। মধ্যরাত পর্যন্ত চলা ওই কনসার্টের কারণে পড়ালেখায় বিঘ্ন ঘটার অভিযোগ তুলেন তাঁরা। শতাধিক শিক্ষার্থী বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে মুক্তমঞ্চে এসে কনসার্ট বন্ধ করে দেন। এসময় বেশ কয়েকটি চেয়ার ভাঙচুর করা হয়।

‘বর্ষ বরণে’র উৎসবে উগ্রবাদের কালো থাবা:

গত ১৪ ফেব্রুয়ারী,২০২৫ ‘ভালবাসা দিবসে’ ফুল বিক্রি করায় দোকান ভাঙচুরের পর টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলায় ঘুড়ি উৎসব বন্ধ করে দিয়েছেন আয়োজকরা।শনিবার বিকালে গোপালপুর উপজেলার নলীন বাজারের পাশে এই উৎসব হওয়ার কথা ছিল। শুক্রবার উৎসববিরোধী একটি প্রচারপত্র বিতরণ করা হয় ওই এলাকায়।

গত ১৪ ফেব্রুয়ারী বাধার মুখে পন্ড হয়েছে উত্তরায় আয়োজিত বসন্ত বরণ উৎসব। সূত্র: বিবিসি বাংলা।

১৪ ফেব্রুয়ারী চট্টগ্রাম নগরের সিআরবির শিরীষতলায় বসন্তবরণ উৎসবের সকালের পর্ব শেষ। দুপুরের বিরতি। বিকেলে উৎসবের আরেকটি পর্ব অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। তবে বিকেলের পর্ব শুরু হওয়ার আগেই অনুষ্ঠানের অনুমতি বাতিল করেছে রেলওয়ে। ফলে মাঝপথে বন্ধ হয়ে যায় চট্টগ্রামে বসন্তবরণ উৎসব। আয়োজক প্রমা আবৃত্তি সংগঠনের এক সংগঠক নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা ১৫ বছর ধরে সিআরবির শিরীষতলায় বসন্তবরণ অনুষ্ঠান করে আসছেন। এবারের মতো পরিস্থিতিতে আগে কখনো পড়তে হয়নি। সব সময় কোনো ধরনের বাধা-বিঘ্ন ছাড়াই অনুষ্ঠান করেছেন।

‘অমর একুশে বইমেলা’য় উগ্রবাদের কালো থাবা:

গত ১০ ফেব্রুয়ারী, একুশে বইমেলায় সব্যসাচী প্রকাশনীর স্টলে তসলিমা নাসরিনের লেখা বই থাকায় স্টল ভাঙচুর করেছে তৌহিদি জনতার নামে উগ্রবাদী গোষ্ঠী। এ ঘটনায় আটক হয়েছেন সব্যসাচী প্রকাশনীর সহ-প্রকাশক শতাব্দী ভব। ভাঙচুরের পর ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেওয়ার অভিযোগ তুলে শতাব্দী ভবকে বইমেলা থেকে বের করে দিয়েছে উগ্রবাদীরা। পাশাপাশি স্টলটি সাময়িক বন্ধ করে দিয়েছে পুলিশ।

গত ১৬ ফেব্রুয়ারী অমর একুশে বইমেলায় নারীস্বাস্থ্য সুরক্ষার স্যানিটারি ন্যাপকিন বিক্রির কারণে দুটি স্টল বন্ধ করে দিয়েছে বাংলা একাডেমি। আজ রোববার বিকেলে স্টল দুটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। মেলা কর্তৃপক্ষ বলছে, বইমেলায় অনুমোদনহীন পণ্য বিক্রির জন্য স্টল দুটি বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি চিঠিতে দেখা যায়, তৌহিদি জনতার নামে দুটি সংগঠন থেকে বাংলা একাডেমিতে স্যানিটারি ন্যাপকিনকে গোপন পণ্য আখ্যা দিয়ে তা বিক্রি বন্ধে দাবি জানানো হয়। সে দাবির সাথে একমত পোষণ করে বন্ধের সুপারিশ করে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম।

‘লালন উৎসবে’ উগ্রবাদের কালো থাবা:

গত ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫ হেফাজতে ইসলামের আপত্তির মুখে টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলায় বন্ধ হয়ে গেছে লালন স্মরণোৎসব। আজ বুধবার দিবাগত রাত ৮টার দিকে মধুপুর উপজেলা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় লালন স্মরণোৎসব-২০২৫ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। ফকির লালন সাঁইজির ১৩৪তম তিরোধান বর্ষ উদযাপন উপলক্ষে মধুপুর লালন সংঘ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে মধুপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. জুবায়ের হোসেনের উপস্থিত থাকার কথা ছিল। এ ব্যাপারে জানতে উৎসব আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক সবুজ মিয়াকে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। তবে তিনি ফেসবুক পোস্টে বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। সবুজ লেখেন, ‘হঠাৎ করেই খবর পাই মধুপুর হেফাজতে ইসলাম আমাদের অনুষ্ঠান নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে।

গত ২৩ নভেম্বর, ২০২৪ নারায়ণগঞ্জে লালন মেলা বন্ধের হুমকির পর আয়োজন পণ্ড, ভক্তরা ফিরে গেছেন।

নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার কাশীপুর ইউনিয়নের নরসিংহপুর গ্রামে ‘মুক্তিধাম আশ্রম ও লালন একাডেমি’ প্রাঙ্গণে শুক্রবার সন্ধ্যায় ‘গুরুকর্ম’ শুরু হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু প্রশাসন ও স্থানীয় ধর্মীয় দলের চাপের মুখে লালন মেলার আয়োজন বন্ধ হয়ে গেছে। স্থানীয় ‘তৌহিদী জনতা’ গ্রুপের বিক্ষোভ ও হুমকির কারণে জেলা প্রশাসন লালন মেলা আয়োজনের অনুমতি দেয়নি। শুক্রবার দুপুরে যখন আশ্রমের প্রাঙ্গণে উপস্থিত হয়ে দেখা গেল, সেখানে সজীব পরিবেশ ছিল না; ত্রিপল সরিয়ে ফেলা হয়েছে এবং লালনভক্তরা ফিরে যাচ্ছিলেন। আয়োজক ফকির শাহ জালাল জানান, প্রশাসনিক নিষেধাজ্ঞার কারণে কোনো ধরনের গান-বাজনা বা সাধুসঙ্গের আয়োজন করা সম্ভব হয়নি।

নারী ফুটবলের উপর উগ্রবাদের কালো থাবা:

গত ৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫ স্থানীয় ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের এক নেতার হুমকির মুখে রংপুরের তারাগঞ্জে মেয়েদের ফুটবল ম্যাচ বন্ধ করে দিয়েছে প্রশাসন।

আজ বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টায় বুড়িরহাট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এই ফুটবল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। ধর্মীয় নেতাদের তীব্র বিরোধিতার মুখে স্থানীয় প্রশাসন মাঠে ১৪৪ ধারা জারি করে এবং ম্যাচটি বাতিল করা হয়।

গত ২৪ জানুয়ারি আক্কেলপুর স্থানীয় ‘টি-স্টার ক্লাব’ জয়পুরহাট ও রংপুর নারী ফুটবল দলের প্রীতি ম্যাচ আয়োজনের ঘোষণা দেয়।  এই ম্যাচের জন্য টিনের বেড়া দিয়ে গ্যালারির তৈরি করা হয়। রাখা হয় টিকেটের ব্যবস্থাও। কিন্তু ম্যাচটি বন্ধ করতে স্থানীয় মুসল্লিরা বিক্ষোভ শুরু করেন। নারীদের ফুটবল খেলা নিয়ে আপত্তি তুলেন তারা। সেই বিক্ষোভ থেকে তিলকপুর উচ্চবিদ্যালয় মাঠের টিনের বেড়া হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করা হলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ম্যাচটি স্থগিত করে দেন

৩০ জানুয়ারি ২০২৫, নারী ফুটবলারদের কটুক্তি, কাঁদলেন অধিনায়ক। বেশ কিছুদিন ধরেই নারী দলকে নিয়ে উঠেছে আলোচনা। নারী ফুটবল দলের অধিনায়ক সাবিনা এবার সেই প্রসঙ্গে কান্নায় ভেঙে পড়লেন

সাবিনা বলেন, ব্যাপারটা আত্মসম্মানের। দিনশেষে মেয়েরা দেশের জন্যই খেলে কিন্তু দেশের মানুষজন যেভাবে মেয়েদের কটুক্তি করছে এটা মেয়েদের জন্য নেওয়া কষ্টকর।

গত ৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪ সাফজয়ী জাতীয় নারী ফুটবলার মাতসুশিমা সুমাইয়া তার ফেসবুকে জানান,

“গত কয়েকদিন ধরে আমি অগণিত মৃত্যু এবং ধর্ষণের হুমকি পেয়েছি”

একের পর এক যখন শিল্প, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বাধার মুখে পন্ড হচ্ছে তা নিয়ে চলছে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা। এ বিষয়ে ‘বিবিসি বাংলা’ বাধার মুখে বন্ধ হচ্ছে একের পর এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শিরোনামে একটি প্রতিবেদন ছাপে। সেখানে বিবিসি বাংলার সাথে কথা বলেন, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবাইদা নাসরীন বিবিসি বাংলাকে বলেন,

“এগুলো কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা না। ধারাবাহিক ঘটনা।”

বর্ষবরণ উৎসব বা লালন উৎসব এই ভূখণ্ডের ঐতিহ্য উল্লেখ করে তিনি বলেন,

“এগুলোর সাথে আমাদের আইডেন্টিটি জড়িত। এগুলোকে স্রেফ গান-বাজনা হিসাবে দেখলে হবে না।

“যা ঘটছে, তা অপরিকল্পিত বা অরাজনৈতিক না। একটি বিশেষ ধর্মান্ধ গোষ্ঠী এগুলো করছে। অথচ কারা করছে, কী প্রক্রিয়ায় করছে, সে বিষয়ে রাষ্ট্রীয় কোনও বক্তব্য এবং পদক্ষেপ নাই।”

তিনি মনে করেন,

“রাষ্ট্রীয় বক্তব্য যে নাই, এটিও রাজনীতির-ই অংশ। সরকার কোন জায়গায় কথা বলছে, কোন জায়গায় কথা বলছে না; সরকার কাদের বিরুদ্ধে কথা বলছে, কাদের বিরুদ্ধে কথা বলছে না; এগুলো সরকারের আদর্শিক রাজনীতি।”

এখানে সরকারের “পৃষ্ঠপোষকতা, সংশ্লিষ্টতা এবং আস্কারা” স্পষ্ট উল্লেখ করে তিনি বলেন, যেই ধরনের হুমকি, অনুষ্ঠান বন্ধ, এগুলো অন্তত তিন মাস ধরে চলছে।” তার মতে, এইসব অনুষ্ঠান বন্ধ করা মানে বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ওপর আঘাত।

বিবিসির অন্য একটি ভিডিও প্রতিবেদনে বলা হয়, একের পর এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বন্ধের বিরুদ্ধে সরকার বা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেই কার্যকর কোনো ব্যবস্থা৷

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বাধার বিষয়ে বিবিসি বাংলার সাথে সাক্ষাৎকারে জনপ্রিয় চিত্রনায়িকা পরিমণি জানান, “নিঃসন্দেহে অনিরাপদ বোধ করছি, এ স্বাধীনতা কারা উপভোগ করতেছে? আমাদের সৃজনশীল কাজে বাধা আসবে আমি অন্তত মেনে নিতে পারি না। যখন কথা বললাম আমাকে হেনস্তা করা হলো”- অভিনেত্রী পরীমনি।

এভাবে একের পর এক যখন শিল্প, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বাধা দেয়া হচ্ছে, নারী ফুটবল বন্ধে হামলা করা হচ্ছে, শিল্পীদের কাজে বাধা দেয়া হচ্ছে তখন প্রশ্ন উঠে রাষ্ট্র বা সরকার কী করছে! বাধা প্রদান কিংবা হামলার এসব ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সরকার বা প্রশাসন এ ধরনের ঘটনায় নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। বইমেলায় প্রকাশকের উপর পুলিশের উপস্থিতিতেই হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব কাজে জড়িতদের গ্রেফতারেও তোড়জোড় দেখা যায়নি সরকারের পক্ষ থেকে।

প্রশ্ন উঠেছে, তবে কী সরকার এসব কাজ করতে উগ্রবাদীদের ছাড় দিচ্ছে কিনা কিংবা সরকারের মধ্যেই কী এমন কোনো শক্তি রয়েছে যারা শিল্প, সংস্কৃতি, মুক্তবুদ্ধিচর্চার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে যার ফলে এতোগুলা ঘটনা ঘটার পরও সরকারের টনক নড়েনি। এছাড়া কোনো আইন অনুযায়ী ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়নি। এমতবস্থায় সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষেরা আশঙ্কা করছেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশের সাংস্কৃতিক কার্যক্রম যেমন, গানের অনুষ্ঠান, নাটক-সিনেমা নির্মাণ, নারীদের ফুটবলের মতো কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে। শিল্পীরা বেকার হয়ে যাবেন। দেশ চলে যাবে ধর্মীয় উগ্রবাদীদের হাতে। যা বহিঃবিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করবে এবং বাংলাদেশকে উগ্রবাদের চারণভূমি আখ্যা দিয়ে দেশের দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতি হবে। শিল্প, সংস্কৃতি কিংবা নারী ফুটবলের উপর উগ্রবাদের কালো থাবায় আশঙ্কিত জনগণের প্রশ্ন, কোন পথে যাচ্ছে বাংলাদেশ?

Share This Article
সংবাদকর্মী
error: Content is protected !!