পাঁচ মাসে ভারতীয় সীমান্তে নিহত ১৩ বাংলাদেশী নাগরিক

২০২০ সালে প্রকাশিত  আইন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)   এর তথ্যানুযায়ীবিএনপি এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ৭.৫ বছরের আমলে সীমান্তে প্রাণ হারায় প্রায় ৭৭০ জন বাংলাদেশি   অন্যদিকে আওয়ামী লীগের ১৭ বছরের আমলে ৪৯৩ জন বাংলাদেশি প্রাণ হারায় সীমান্তে।গত ১২ বছরে সীমান্তে বিএসএফের হত্যা অনেকাংশে কমে এসেছে অন্য যেকোন সময়ের তুলনায়।

হায়দার আহমেদ
9 Min Read
সীমান্তে সতর্ক অবস্থান

আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ড.ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। তারা ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রথম ৫ মাসে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলিতে প্রাণ হারায় ১৩ জন এবং আহত হয় বেশ কজন।এছাড়া অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে ভারতীয় বাহিনীর নিকট আটক হয়ে সেদেশে জেলে বন্দি রয়েছেন ২০ বাংলাদেশী নাগরিক। অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকার সীমান্ত হত্যার বিরুদ্ধে বিবৃতি আর প্রতিবাদ লিপিতেই সীমাবদ্ধ। নেই দৃশ্যমান কোনো প্রদক্ষেপ। 

বাংলাদেশের বৃহৎ প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত। ভারতের সাথে বাংলাদেশের রয়েছে প্রায় ৪ হাজার কিলোমিটারের দীর্ঘ সীমান্ত। যে সীমান্ত পথ মাদক, চোরাচালানের রুট হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই। এই মাদক, চোরাচালান, অবৈধ মানবপাচার করতে গিয়ে সীমান্তে ভারতীয় বাহিনী বিএসএফ কতৃক শত শত মানুষের মৃত্যু হয়েছে গত ৫৩ বছরে। প্রতিবাদ, বিবৃতি, আলোচনার পরও থামানো যায়নি সীমান্ত হত্যা।

 বাংলাদেশে গত ১৫ বছরের অধিক সময় শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব পালন করেছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সীমান্ত হত্যার জন্য আওয়ামী লীগের ভারতের সাথে নতজানু সম্পর্ককে দায়ী করে এসেছে এতদিন।

দায়িত্ব পালনে বাধায় বিজিবির প্রতিবাদ
দায়িত্ব পালনে বাধায় বিজিবির প্রতিবাদ । ছবিঃসময়

কিন্তু ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ড.ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে সরকার প্রধান, বেশ কয়েকজন উপদেষ্টা এবং সরকারি দলের ছাত্র সংগঠন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও তাদের রাজনৈতিক সংগঠন জাতীয় নাগরিক কমিটির শীর্ষ নেতারা ক্রমাগত ভারত বিরোধিতা এবং উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে আসছে। বৃহত্তর বাংলার মানচিত্র ও প্রকাশ করেছে একজন উপদেষ্টা। সেভেন সিস্টার্স ভেঙ্গে দেয়ার হুমকিও দিয়েছে কেউ কেউ। প্রবল ভারত বিরোধি সরকার হিসেবে তারা ইতোমধ্যে পরিচিতি লাভ করেছেন তারা। কিন্তু এতোকিছুর পরও বন্ধ হয়নি সীমান্ত হত্যা। গত ৫ মাসে সীমান্তে ভারতীয়দের গুলিতে মারা গেছে ১৩ জন, আহত হয়েছে অনেক এবং আটক হয়েছে ২০ বাংলাদেশী নাগরিক। তাহলে সরকার এবং রাজনৈতিক নেতাদের ভারত বিরোধিতা বা শক্তিশালী কূটনীতির যে গর্জন, তা কী কাগুজে বাঘ কিনা ইতোমধ্যে এ নিয়ে শুরু হয়েছে জোরালো সমালোচনা। 

সীমান্ত হত্যার ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত ১৩ আগস্ট, ২০২৪ চাঁপাইনবাবগঞ্জের ওয়াহেদপুর সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে আবদুল্লাহ (৪৫) নামের এক বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। সূত্রঃ সমকাল

গত ১ সেপ্টেম্বর মৌলভীবাজারের কুলাউড়া সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে স্বর্ণা দাস নামের এক কিশোরী নিহত হয়। সে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলো।  সূত্রঃ সময়

৮ সেপ্টেম্বর ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে বাংলাদেশি এক কিশোর নিহত হয়েছে। নিহত কিশোরের নাম জয়ন্ত কুমার সিংহ (১৫)। সে বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার ফকিরভিটা বেলপুকুর গ্রামের বাসিন্দা মহাদেব কুমার সিংহের ছেলে। এ ঘটনায় মহাদেব কুমার সিংহ ও নিটালডোবা গ্রামের দরবার আলী নামের আরেক ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।সীমান্তের কাঁটাতার পেরিয়ে যাওয়ার সময় ভারতের অভ্যন্তরে ১৬ জন বাংলাদেশি বিএসএফ সদস্যের হাতে আটক হয়েছেন বলেও জানান ইউপি চেয়ারম্যান সমর কুমার চট্টোপাধ্যায়।  সূত্রঃ প্রথম আলো

জয়ন্ত কুমার সিংহ
জয়ন্ত কুমার সিংহ
ছবি: সংগৃহীত

গত ৭ অক্টোবর কুমিল্লা সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলা সীমান্তে বাংলাদেশি যুবক কামাল হোসেন বিএসএফের গুলিতে নিহত হয়। নিহত কামাল হোসেন (৩২) উপজেলার জোলাই কুড়িয়াপাড়া গ্রামের ইদু মিয়ার ছেলে। তার লাশ বিএসএফ নিয়ে যায়। সূত্রঃ বিডিনিউজ ২৪

গত ২৪ অক্টোবর ময়মনসিংহের ধোবাউড়া সীমান্তে রাতের বেলা ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলিতে এক বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। নিহত ব্যক্তির নাম রেজাউল করিম। তিনি শেরপুর সদর, নারায়ণপুর এলাকার বাসিন্দা। তিনি পেশায় একজন ওষুধ ব্যবসায়ী। বিজিবি জানায়, অবৈধভাবে ভারত থেকে ওষুধ আনার সময় বিএসএফের গুলিতে তিনি নিহত হন। সূত্রঃ যুগান্তর

গত ৪ ডিসেম্বর সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ সীমান্তের ওপার থেকে কাঠ আনতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে আশরাফ উদ্দিন নামে এক বৃদ্ধ নিহত হয়েছেন। তিনি ভাটরাই গ্রামের মৃত শামসুদ্দিনের ছেলে। গতকাল বুধবার সকাল ৯টার দিকে সীমান্তের ওপারে তার লাশ পড়ে থাকতে দেখেন স্বজনরা। পরে সন্ধ্যায় দুই দেশের পুলিশের উপস্থিতিতে বিএসএফ বিজিবির কাছে লাশ হস্তান্তর করে। সূত্র ঃ ইনকিলাব

গত ৬ ডিসেম্বর পঞ্চগড় সদর উপজেলার মোমিনপাড়া সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে ভারত থেকে বাংলাদেশে গরু পাচারের সময় বিএসএফের গুলিতে আনোয়ার হোসেন (৪০) নামের এক বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। শুক্রবার (৬ ডিসেম্বর) ভারতের অভ্যন্তরে শিংপাড়ায় এ ঘটনা ঘটে। সূত্রঃ বিডিনিউজ ২৪

গত ১৮ ডিসেম্বর যশোরের শার্শা ও বেনাপোল সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ সদস্যদের নির্যাতনে তিন বাংলাদেশি নিহত হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। তাদের মধ্যে শার্শা উপজেলার পাঁচভূলাট সীমান্ত থেকে একজনের লাশ উদ্ধার করা হয়।

ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে নিহত স্বর্ণা দাস। ছবি: সংগৃহীত
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে নিহত স্বর্ণা দাস। ছবি: সংগৃহীত

বেনাপোলের পুটখালী সীমান্ত থেকে আহত অবস্থায় উদ্ধারের পর মৃত্যু হয় একজনের। আরেকজনের লাশ শার্শার অগ্রভূলাট সীমান্ত এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। সবার শরীরে একাধিক আঘাতের চিহ্ন রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। নিহতরা হলেন– বেনাপোলের কাগজপুকুর গ্রামের মৃত ইউনুচ আলী মোড়লের ছেলে জাহাঙ্গীর আলম (৫০), দিঘিরপাড় গ্রামের আরিফ হোসেনের ছেলে সাবুর আলী (২৮) এবং চৌগাছা উপজেলার সাদাতপুর গ্রামের সাকিবুল (২০)। তাদের মধ্যে সাকিবুল দিঘিরপাড় গ্রামে নানাবাড়িতে থাকতেন। সূত্রঃ সমকাল

গত ২১ ডিসেম্বর মৌলভীবাজারের বড়লেখায় বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের জিরো লাইন থেকে গোপাল বাগতি (৩৬) নামে এক চা শ্রমিকের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। ২২ ডিসেম্বর) দুপুরে নিহতের স্বজনের উপস্থিতিতে বিজিবি ও পুলিশ তার লাশ উদ্ধার করেছে। সূত্রঃ বাংলানিউজ ২৪

গত ৮ জানুয়ারি ২০২৫ সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার মাছিমপুর সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে এক বাংলাদেশি যুবক নিহত হয়েছেন। বুধবার (৮ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় মাছিমপুর সীমান্তে এ ঘটনা ঘটে। নিহত যুবকের নাম সাইদুল ইসলাম (২৩)। তিনি বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ধনপুর ইউনিয়নের গামারিতলা গ্রামের জয়নুল আবেদীনের ছেলে। বিষয়টি বাংলা ট্রিবিউনকে নিশ্চিত করেছেন বিশ্বম্ভরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোখলেছুর রহমান। সূত্রঃ বাংলা ট্রিবিউন

১ দিন পরেই অর্থাৎ ৯ জানুয়ারি হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার বড় কেয়ারা সীমান্ত এলাকায় নিহত জহুর আলীর (৫৫) লাশ হস্তান্তর করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। নিহতের পরিবার ও এলাকাবাসীর অভিযোগ,

বিএসএফ ও সীমান্তের ওপারের ভারতীয় লোকজন জহুর আলীকে পিটিয়ে হত্যা করে। তবে বিএসএফ দাবি করেছে, পিটিয়ে নয়, বরং হৃৎক্রিয়া ও নিউমোনিয়াজনিত কারণে তাঁদের ভৌগোলিক সীমানায় ওই ব্যক্তি মারা যান। পরে তাঁর লাশ উদ্ধার করে ত্রিপুরা রাজ্যের খোয়াই মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে যায় ভারতীয় পুলিশ।

এছাড়া বিএসএফের গুলিতে এবং নির্যাতনে আহত হয় বেশ কজন বাংলাদেশি নাগরিক। ৮ সেপ্টেম্বর ঠাকুরগাঁও সীমান্ত দুজন আহত হয়, যেদিন একজন মারাও যায় সেখানে৷ আটক হয় ১৬ জন। যা এ রিপোর্টে ইতোমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে। সূত্র: প্রথম আলো(৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪)

গত ২৬ নভেম্বর ২০২৪ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার বায়েক ইউনিয়নের পুটিয়া সীমান্তে সোমবার (২৫ নভেম্বর) বিকেলে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে দুই বাংলাদেশি আহত হয়েছেন।  সূত্রঃ বিডি জার্নাল

গত ৬ ডিসেম্বর, ২০২৪ ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফের) গুলিতে হেলালুজ্জামান ওরফে হেলাল উদ্দিন (৩৬) নামের এক বাংলাদেশি যুবক আহত হয়েছেন, লালমনিরহাটের আদিতমারীর দুর্গাপুরের কুটিপাড় সীমান্তে শুক্রবার (৬ ডিসেম্বর) রাতে ভারতের ভেতরে এ ঘটনা ঘটনা সূত্রঃ ভয়েস অব আমেরিকা

গত ১০ আগস্ট ২০২৪ ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার কোটপাড়া সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিএসএফের গুলিতে এক বাংলাদেশি যুবক গুরুতর আহত হয়েছেন। সূত্রঃ বিডি নিউজ ২৪

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পরও অব্যাহত সীমান্ত হত্যা, আহত এবং আটকের ঘটনায় সামাজিক  যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন বাংলাদেশের নাগরিকরা।

 ২০২০ সালে প্রকাশিত  আইন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)   এর তথ্যানুযায়ী

বিএনপি এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ৭.৫ বছরের আমলে সীমান্তে প্রাণ হারায় প্রায় ৭৭০ জন বাংলাদেশি   অন্যদিকে আওয়ামী লীগের ১৭ বছরের আমলে ৪৯৩ জন বাংলাদেশি প্রাণ হারায় সীমান্তে।গত ১২ বছরে সীমান্তে বিএসএফের হত্যা অনেকাংশে কমে এসেছে অন্য যেকোন সময়ের তুলনায়।

অনেকেই সরকারকে দুষছেন দুর্বল কূটনীতি এবং যথাযথ প্রদক্ষেপ না নেয়ার জন্য। কেউ কেউ মনে করছেন জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় থাকলে এ বিষয়ে আরো শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারবে এবং ভারতের উপর আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে চাপ সৃষ্টি করতে পারবে। একদিকে সরকারের উপদেষ্টা এবং সরকার সমর্থক রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ ভারত বিরোধি বক্তব্য দিচ্ছে, অন্যদিকে সীমান্তে উত্তেজনা এবং ভারতীয় বাহিনীর গুলিতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।

Share This Article
সংবাদকর্মী
error: Content is protected !!