আগস্টের সহিংসতায় নিহতদের মধ্যে যারা লুটপাটের সময় প্রাণ হারিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে, তাদের ‘শহীদ’ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করাকে ঘিরে বিতর্ক তৈরি হয়েছে।৫ আগস্টের পর দেশজুড়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও সমর্থকদের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। দেশীয় গণমাধ্যমের একাধিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, এসব ঘটনায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে অনেকে মারা যান। নিহতদের মধ্যে হামলাকারী, লুটেরা এবং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী—সব ধরনের পরিচয়ের মানুষ থাকতে পারেন বলে মনে করা হচ্ছে।তবে নিহত ব্যক্তিরা ঠিক কী কারণে প্রাণ হারিয়েছেন—লুটপাটে অংশ নিতে গিয়ে নাকি রাজনৈতিক সহিংসতায় আক্রান্ত হয়ে—তা স্পষ্ট নয়। এমনকি ধর্ষণের চেষ্টার সময় গণপিটুনিতে নিহত কয়েকজনের নামও ‘জুলাই শহীদ’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এই অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদনটিতে আমরা হত্যাকাণ্ড, লুটপাট ও অগ্নিদগ্ধ মৃত্যুর পেছনের বাস্তবতা উদঘাটন করতে চেষ্টা করবো। পাশাপাশি নিহত ব্যক্তিদের প্রকৃত পরিচয় যাচাই ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দাবি-দাওয়া ও সামাজিক প্রতিক্রিয়ার আলোকে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করা হবে।
ধানমন্ডি ৩২ লুট করতে এসে আগ্নিদগ্ধ হয়ে দুজনের মৃত্যু
প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়ির সামনে পুরোনো ছিটকাপড় দিয়ে ঢাকা দুটি অজ্ঞাতপরিচয় লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। কৌতূহলী মানুষ মৃতদেহ দুটি ঘিরে ভিড় করে। এই লাশগুলো লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার শিকার বলে ধারণা করা হয়।দি বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের প্রতিবেদন আরও বিশদভাবে জানায় যে, তাদের প্রতিবেদক ৫ আগস্ট দিনভর চলা লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগের পর ঘটনাস্থলে একাধিক দগ্ধ মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেছেন। এই মৃতদেহগুলো কারা, বা তারা কীভাবে মারা গেছেন, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পরিচয় তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি।

নাটোর-২ (সদর ও নলডাঙ্গা) আসনের সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুলের বাড়িতে লুট করতে গিয়ে অগ্নিদগ্ধ চারজনের মৃত্যু।

নাটোর-২ (সদর ও নলডাঙ্গা) আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুলের বাসভবনে বিক্ষুব্ধ জনতার অগ্নিসংযোগে চারজনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। ৫ই আগস্ট, ২০২৪-এর ঘটনাপ্রবাহের পরদিন, ৬ই আগস্ট, ২০২৪ মঙ্গলবার সকালে শহরের ‘জান্নাতি প্যালেস’ নামক সংসদ সদস্যের বাড়িটির বিভিন্ন কক্ষ, বারান্দা এবং ছাদ থেকে তাদের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।সূত্রঃ ২৪ নিউজ ও ঢাকা পোস্ট।
নিহতরা হলেন:
- আকিব খান (১৭): নাটোর সিটি কলেজের অধ্যক্ষ দেলোয়ার হোসেন খানের ছেলে। আকিব সদ্য এসএসসি পাস করেছিল এবং প্রথম আলোর ভাষ্যমতে, সে নাটোর সিটি কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র ছিল। তার বাবা দেলোয়ার হোসেন একই কলেজের অধ্যক্ষ এবং জেলা জামায়াতের সাবেক সেক্রেটারি।
- সিয়াম হোসেন (১৯): তালতলা এলাকার বকুল হোসেনের ছেলে এবং একজন এইচএসসি পরীক্ষার্থী।
- শফিকুল ইসলাম মোহন (২০): বড়গাছা এলাকার আব্দুল মজিদের ছেলে।
- ইয়াসিন আলী (২০): মল্লিকহাটি এলাকার ফজের আলীর ছেলে।
প্রথম আলো নিহতদের রাজনৈতিক পরিচয় উল্লেখ করেনি। প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সূত্রে জানা গেছে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর সোমবার বিকেলে সংসদ সদস্য শফিকুলের ওই বাড়িতে বিক্ষুব্ধ জনতা আগুন দেয়। একই সময়ে বাড়িটির পাশে তাঁর ছোট ভাইয়ের একটি পাঁচতলা বাড়ি এবং সংসদ সদস্যের পুরোনো বাড়িতেও অগ্নিসংযোগ করা হয়। তিনটি বাড়িতেই ব্যাপক লুটপাট চলে। পরবর্তীকালে, দৈনিক সংবাদ জানিয়েছে যে, ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ তারিখে সাবেক সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলামের সেই পোড়া বাড়িতে আবারও আগুন ও লুটের ঘটনা ঘটে।
লালমনিরহাটে জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সুমন খানের বাড়ি লুট করতে গিয়ে অগ্নিদগ্ধ ছয় জনের মৃত্যু

লালমনিরহাটে আওয়ামী লীগ নেতার বাড়িতে অগ্নিসংযোগে ছয়জনের মৃত্যু, হত্যা মামলা দায়ের।গত ৫ আগস্ট, ২০২৪ তারিখে লালমনিরহাটে আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগের পর এক আনন্দ মিছিল বের হয়। এই মিছিল থেকে আন্দোলনকারী প্রথমে লালমনিরহাট-৩ আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য মতিয়ার রহমানের বাড়িতে হামলা চালিয়ে অগ্নিসংযোগ করে এবং তার গাড়ি পুড়িয়ে দেয়।
একই দিন বিকেলে জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন ওরফে সুমন খানের (৪৬) শহরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার সংলগ্ন বহুতল বাসভবনে আন্দোলনকারীরা আগুন ধরিয়ে দেয়। মানবজমিনের ৭ আগস্ট, ২০২৪ তারিখের সংবাদ অনুযায়ী, হামলাকারীরা দুটি দলে বিভক্ত হয়ে কাজ করে। একটি গ্রুপে ৭ জন যুবক বাড়ির ভেতরে ঢুকে লুটপাট শুরু করে এবং উপরের তলায় চলে যায়। তারা নিচে নামার আগেই অন্য একটি দল বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। ফলে, ভেতরে আটকা পড়ে ওই যুবকরা আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা যায়। একজন যুবক ছাদ থেকে লাফ দিয়ে রক্ষা পেলেও তাকে আহত অবস্থায় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
এই ঘটনায় নিহত ছয়জন হলেন:
- তন্ময় আহম্মেদ: হাড়িভাঙ্গার মৃত জহেদুল ইসলাম খোকনের পুত্র।
- শ্রাবণ: খাতাপাড়ার লালমনিরহাট সরকারি কলেজের সাবেক ভিপি সাইদুল ইসলাম মিঠুলের পুত্র।
- জনি: সেকেন্দার আলীর পুত্র।
- মো. রাজিবুল করিম: রেজাউল করিম সরকারের পুত্র।
- রাদিক হোসেন রিদে: জিয়াউর রহমানের পুত্র।
- অন্য একজনের পরিচয় এই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়নি।
যদিও দগ্ধ হওয়া ব্যক্তিরা কোন রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত ছিলেন, তা তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি।
তবে, ঘটনার ৯ মাস ২২ দিন পর, ২৮ মে, ২০২৫ তারিখে প্রথম আলোর প্রকাশিত সংবাদে জানানো হয় যে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় লালমনিরহাটে আওয়ামী লীগ নেতার বাড়িতে আগুনে পুড়ে ছয়জন নিহতের ঘটনায় ৭৩ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলার আসামিদের প্রায় সবাই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী। এ ঘটনায় পুলিশ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে। নিহত ব্যক্তিদের সহযোদ্ধা পরিচয় দেওয়া আরমান আরিফ (২৭) নামের একজন তরুণ এই মামলাটি করেছেন। তিনি লালমনিরহাট শহরের নর্থ বেঙ্গল মোড় এলাকার বাসিন্দা এবং তার রাজনৈতিক পরিচয় জানা যায়নি। মামলার এজাহারে দাবি করা হয়, নিহত ছয়জনই ‘ছাত্র-জনতার আন্দোলন’-এর অংশ ছিলেন।
যশোরে পুড়ে যাওয়া হোটেলে লুটপাট, মৃতের সংখ্যা বেড়ে ২৪, প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন মৃতের সংখ্যা ৫২ জন

গত ৫ আগস্ট, ২০২৪ তারিখে যশোরের চিত্রা মোড়ে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও তৎকালীন সংসদ সদস্য শাহীন চাকলাদারের মালিকানাধীন জাবির ইন্টারন্যাশনাল হোটেলে ভয়াবহ লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ২৪ জনে দাঁড়িয়েছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রাথমিকভাবে জানা যায়, তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা মৃতের সংখ্যা ৫২ জন বলে দাবি করেছেন।
বাংলা নিউজ সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের খবরে বিক্ষুব্ধ জনতার একটি মিছিল হোটেল জাবির ইন্টারন্যাশনালে ভাঙচুর শুরু করে। এরপর বিকেল ৪টার দিকে দ্বিতীয় দফায় সেখানে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। রাত সাড়ে ৯টায় পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও পরদিন মঙ্গলবার ভোর ৫টার দিকে আগুন পুরোপুরি নেভানো সম্ভব হয়।
আজকের পত্রিকার ভাষ্যমতে, যশোর জেনারেল হাসপাতাল এবং আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিহতদের বেশিরভাগই আন্দোলনকারী। ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের সময় অনেকেই কৌতূহলবশত অগ্নিসংযোগকারীদের সঙ্গে হোটেলে প্রবেশ করেন। প্রায় দুই শতাধিক আন্দোলনকারী হোটেলের বেসমেন্ট থেকে সিঁড়ি বেয়ে ১৪ তলা পর্যন্ত উঠে যায়। একপর্যায়ে, নিচে থাকা বিক্ষুব্ধ আন্দোলনকারীদের মধ্যে কয়েকজন যুবক পেট্রল দিয়ে আগুন দিতে শুরু করে। পর্যায়ক্রমে তারা কয়েকটি তলায় আগুন ধরিয়ে দেয়, যার ফলে মুহূর্তের মধ্যে পুরো ১৪ তলা দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে। এতে উপরের তলায় আটকা পড়া বেশিরভাগ আন্দোলনকারী বের হতে পারেননি এবং আগুনের ধোঁয়ায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যান। তবে, কতজন আন্দোলনকারী বা হোটেলটির অতিথি, কর্মকর্তা, কর্মচারী মারা গেছেন, তা নির্দিষ্টভাবে কেউ বলতে পারেনি।
ট্রু গেজেটকে যশোরের কয়েকজন বাসিন্দা জানিয়েছেন,
নিহতের সংখ্যা ৫২ ছাড়িয়ে গেছে, কিন্তু তা প্রকাশ্যে আনা হচ্ছে না। তাদের মতে, যারা আগুন লাগিয়েছিলেন, তারা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে এ তথ্য গোপন রাখা হচ্ছে।’
কুমিল্লায় সাবেক কাউন্সিলরের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করতে গিয়ে ৬ জনের মৃত্যু

গত ৫ আগস্ট, ২০২৪ সোমবার রাতে কুমিল্লা নগরীর অশোকতলায় সাবেক কাউন্সিলর মো. শাহ আলমের তিনতলা বাড়িতে দুষ্কৃতকারীদের অগ্নিসংযোগে ছয়জন নিহত হন। নিহতদের মৃতদেহ সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার সকালের মধ্যে বাড়িটি থেকে উদ্ধার করা হয়।
নিহতরা হলেন:
- শাওন (১২)
- আশিক (১৪)
- শাকিল (১৪)
- রনি (১৬)
- মহিন (১৭)
- মাহফুজুর রহমান (২২)
২৪ নিউজ ও অর্থসূচক সূত্রে জানা গেছে, সোমবার রাত ৮টার একটু আগে প্রায় অর্ধশতাধিক আন্দোলনকারী শাহ আলমের বাড়িতে হামলা চালায়। হামলাকারীদের মধ্যে কয়েকজন তিনতলায় উঠে যায়, আর অন্যরা বাড়ির নিচতলায় আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে তিনতলায় অবস্থানরত আন্দোলনকারীরা ধোঁয়ায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে এবং কেউ কেউ আগুনে পুড়ে মারা যান। প্রথম আলোর প্রতিবেদনও এই ঘটনার একই চিত্র তুলে ধরেছে।প্রথম আলো জানায়ঃ প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গতকাল সোমবার আনুমানিক রাত ৮টার দিকে বিক্ষুব্ধ জনতা অশোকতলায় কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর শাহ আলমের বাড়িতে হামলা চালায়। একপর্যায়ে কয়েকজন বাড়িটির তিনতলায় উঠে পড়েন। এ সময় অন্যরা বাড়িটির নিচতলায় আগুন লাগিয়ে দেয়। পরে তিনতলায় অবস্থানকারীরা ধোঁয়ায় শ্বাস বন্ধ এবং আগুনে পুড়ে নিহত হয়।
লুটের পর গাজী টায়ার কারখানায় আগুন, নিখোঁজের তালিকায় ১৭৩ জনের নাম

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে অবস্থিত গাজী টায়ার কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রাথমিকভাবে ১৭৩ জন নিখোঁজ রয়েছেন। কারখানা কর্তৃপক্ষের দাবি, নিখোঁজদের কেউই কারখানার নিয়মিত শ্রমিক নন। তাদের ধারণা, হামলা চালিয়ে লুটপাট বা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে তারা কারখানায় প্রবেশ করেছিলেন।
প্রথম আলোর তথ্য অনুযায়ী, অগ্নিকাণ্ডের পর সোমবার দুপুরে কারখানার সামনে নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনরা ভিড় করতে শুরু করলে ফায়ার সার্ভিস নিখোঁজের তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেয়। দুপুর পৌনে ৩টা পর্যন্ত ১৭৩ জনের একটি তালিকা প্রস্তুত করা হয়।
তবে, নিখোঁজের সংখ্যা নিয়ে ধোঁয়াশা দেখা দেয়। ফায়ার সার্ভিস শুরুতে ১৭৪ জনের তালিকা করলেও, পরে স্থানীয় শিক্ষার্থীরা ১৩১ জনের নতুন একটি তালিকা তৈরি করে। এরপর উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়, যেখানে নামের তালিকা যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের কথা জানানো হয়। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আট সদস্যের একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছিল, যাদের ১০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা থাকলেও, ১০ অক্টোবর পর্যন্ত কমিটি কোনো প্রতিবেদন জমা দেয়নি। ফলে, এই ঘটনায় ঠিক কতজন নিখোঁজ, তা এখনো নিশ্চিতভাবে জানানো হয়নি।
বাংলা ট্রিবিউন সূত্রে জানা যায়, নিখোঁজ আবু বকর নাঈমের মা নাজমা বেগম বরপা এলাকায় বসবাস করেন। তিনি জানান,
তার ছেলে স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় অষ্টম শ্রেণিতে পড়ত এবং মাদ্রাসার ছাত্রাবাসে থাকত। তিনি বলেন, “গাজী টায়ার কারখানা থেকে মাদ্রাসার দূরত্ব ১০ মিনিটের। আগুন লাগার একদিন পর নিখোঁজের বিষয়টি জানতে পেরেছি। ওই দিন মাদ্রাসার শিক্ষকরা আমাকে ফোন করে বিষয়টি নিশ্চিত করেন। অগ্নিকাণ্ডের দিন আমার ছেলেসহ মাদ্রাসার আরেক ছাত্র এশার নামাজের পর রাত ৯টার দিকে কারখানার দিকে যায়। এরপর থেকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আবু বকরের এখনও খোঁজ পাইনি। পত্রিকায় নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছি, ফেসবুকে দিয়েছি। কিন্তু কিছুতেই কাজ হয়নি। আমার ছেলে হয়তো সেখানে পুড়ে মারা গেছে।”
ধর্ষণ করে আন্দোলনকারীদের গণপিটুনিতে মৃত্যু, পরবর্তীতে জুলাই শহীদ

সমকালের অনুসন্ধানে যাত্রাবাড়ীতে ধর্ষণের অভিযোগের জেরে গণপিটুনিতে তিনজনের মৃত্যুর মর্মান্তিক ঘটনা উঠে এসেছে। প্রত্যক্ষদর্শী ও হোটেলকর্মীদের ভাষ্য অনুযায়ী, ঘটনার সূত্রপাত হয় তল্লাশি চালানোর পর ধর্ষণের অভিযোগ ওঠার মধ্য দিয়ে।
অভিযোগ ওঠার পর, যাত্রাবাড়ী থানা পাহারার দায়িত্বে থাকা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা তিনজনকে আটক করে নির্মমভাবে মারধর করে। এই গণপিটুনিতে দুজনের মৃত্যু হয়। নিহতরা হলেন:
- সাইদুল ইসলাম ইয়াসিন (১৯): যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালী বড় মাদ্রাসার একজন শিক্ষার্থী।
- সাঈদ আরাফাত শরীফ (২০): একজন অনলাইন পোশাক বিক্রেতা।
কিছু সময়ের ব্যবধানে আরেকটি ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আবাসিক হোটেল রোজ ভিউর ব্যবস্থাপক রাহাত হাসান বিপুকে (৫৩) সায়েদাবাদ এলাকায় পিটিয়ে হত্যা করা হয়।ঘটনার সময়ের বেশ কিছু ভিডিও ফুটেজে ভুক্তভোগী তরুণীর জবানবন্দি, অভিযুক্তদের নির্মমভাবে পেটানো এবং তাদের ক্ষমা চাওয়ার দৃশ্য দেখা গেছে।ঘটনার সময়ের একটি ভিডিওতে দেখা যায়, হাত পেছনে বেঁধে লেগুনায় তোলার পর দ্বিতীয় দফায় বিপুকে জুতা দিয়ে আঘাত করা হচ্ছে। আরেকটি ভিডিওতে ঘরের ভেতর তাঁকে লাঠি দিয়ে পেটানো হচ্ছে। তিনি বারবার ক্ষমা চাচ্ছেন।পিটুনিতে আহত শিক্ষার্থী সায়েম গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি। তবে তাঁর ভাই মো. আবদুল্লাহ বলেন, ছাত্ররা হোটেলে তল্লাশি চালানোর পর ওই তরুণী ধর্ষণের মিথ্যা অভিযোগ তোলেন।
দেশের মূলধারার সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, গত ৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের সময় ২৪৫ জন অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান। পাশাপাশি, আন্দোলনের পরে ধর্ষণের অভিযোগে তিনজনকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়। এদের রাজনৈতিক পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি।সম্প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জুলাই ও আগস্ট মাসে নিহত ৮৩৪ জনের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে তাদের ওয়েবসাইটে। এ তালিকায় দেখা গেছে, লুটপাট ও ধর্ষণের ঘটনায় জড়িত হয়ে নিহত হওয়া অনেককেই ‘জুলাই শহীদ’ হিসেবে দেখানো হয়েছে এবং তাদের পরিবারকে সরকারি ভাতা দেওয়া হয়েছে।
এই তালিকা ঘিরে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ, লুট করতে গিয়ে আগুনে দগ্ধ হওয়া বা ধর্ষণে জড়িত থেকে গণপিটুনিতে নিহত ব্যক্তিদের রাজনৈতিক আন্দোলনের শহীদ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এতে ইতিহাস বিকৃতির পাশাপাশি বিচারহীনতার সংস্কৃতি আরও গভীর হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।এই কালার রেভলিউশন আন্দোলন কীভাবে দুষ্কৃতিকারীদের আশ্রয়স্থলে পরিণত হলো, সে প্রশ্ন এখন রাষ্ট্র, রাজনৈতিক দল ও সমাজের সামনে। নিহতদের প্রকৃত পরিচয় ও উদ্দেশ্য যাচাই না করে শহীদ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা রাজনৈতিক উদ্দ্যেশ্য কিনা সে প্রশ্ন উঠেছে।