ছিনতাইয়ের মহোৎসবের নেপথ্যে ‘১৩৮’ কিশোর গ্যাং, নেতৃত্বে নাগরিক কমিটির দুই নেতা!

কিশোর গ্যাং ১৩৮ নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, তাদের সবচেয়ে বেশি সদস্য রয়েছে, রাজধানীর মোহাম্মদপুর, বসিলা, পুরান ঢাকা, মিরপুর, কেরানীগঞ্জ, যাত্রাবাড়ি, টঙ্গী, উত্তরা ও রামপুরা-বাড্ডা এলাকায়। সাম্প্রতিক ছিনতাইয়ের অধিকাংশ ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা যায় তা এসব এলাকাগুলোতে ঘটেছিলো। এমনই একটি কিশোর গ্যাং যারা মোহাম্মদপুরে সক্রিয় রয়েছে এবং ১৩৮ এর হয়ে কাজ করে। তার দলনেতার সাথে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। নাম, পরিচয় গোপন রাখার স্বার্থে তিনি কিছু ভয়ংকর তথ্য প্রদান করেন।

হায়দার আহমেদ
9 Min Read

সম্প্রতি সারাদেশে চলছে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই এবং ধর্ষণের মতো অপরাধের মহোৎসব। ঢাকায় ছিনতাই, ডাকাতির এসব ঘটনার নেপথ্যে নাম উঠে এসেছে, আওয়ামী লীগ সরকার পতন করতে ব্যবহৃত হওয়া সশস্ত্র গ্রুপ ‘১৩৮’ কিশোর গ্যাংয়ের নাম। যার নেতৃত্বে রয়েছে ইউনূস সরকারের রাজনৈতিক শাখা জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতা মোল্লা মোহাম্মদ ফারুকী এহসান এবং আরাফাত রহমান শৈশব।

গতকাল সারারাত টক অব অব দ্যা কান্ট্রি ছিলো, অব্যাহত  ছিনতাই, ধর্ষণ, ডাকাতির ঘটনা। আতংকে মানুষ রাজপথে নেমে প্রতিবাদ মিছিল করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে ড.ইউনূস এবং ছাত্র নেতৃত্বের দ্বারা গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার তুমুল সমালোচনা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেশের জনগণকে হায়হুতাশ করতে দেখা গিয়েছে, তাদের ভাষ্যমতে ৫ আগস্টের পূর্বে তারা নিরাপদ ছিলেন। দেশের এমন অরাজক পরিস্থিতি গত ১৫ বছরে তারা দেখেননি। তারা নিরাপত্তার অভাবে বাসা থেকে বের হতে ভয় পাচ্ছেন৷ দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ নতুবা পদত্যাগের দাবিও তুলেছেন কেউ কেউ।

গতানুগতিক শাসন ব্যবস্থার প্রতি ক্ষোভ ও পরিবর্তনের আশায় কোটা বিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা  সরকার পতন আন্দোলনে ব্যাপক জনরোষে ক্ষমতা ছাড়তে হয় শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগকে। দীর্ঘ সাড়ে পনেরো বছরের শাসন শেষে মানুষ ভেবেছিলো এবার সত্যিই হবে সংস্কার ও পরিবর্তন। কিন্তু ৮ আগস্ট ২০২৪ দায়িত্ব নেয়া অন্তর্বর্তী সরকারের ৬ মাস পেরোলেও মানুষের সে স্বপ্ন বর্তমানে দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে।

২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫ পত্রিকার তথ্যমতে, খুন-খারাবি, চুরি-ছিনতাইর ব্যাপকতা রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশেই। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য বলছে, শুধু রাজধানীতে গেল ছয় মাসে খুনের ঘটনা আড়াই’শ প্রায়। আর চুরি-ছিনতাই ও ডাকাতি ৭৭২ টি। এসব ঘটনা বিশ্লেষণে দেখা যায়, রাতের আঁধারে রাজধানীতে অপরাধ সবচেয়ে বেশি। বেকারত্ব ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর জনগণের আস্থা না থাকাকে অপরাধ বৃদ্ধির বড় কারণ মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

শুধুমাত্র রাজধানীতেই ৬ মাসে ২৫০ জন মানুষের হত্যা কিংবা চুরি-ছিনতাই, ডাকাতির ৭৭২ টি ঘটনা নিঃসন্দেহে আঁতকে উঠার মতো ঘটনা । এ বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, ঢাকায় অধিকাংশ ছিনতাই, ডাকাতি এবং হত্যার ঘটনার সাথে ‘১৩৮’ নামের একটি কিশোর গ্যাং ফেডারেশন জড়িত। এর বাইরেও ঘটনা ঘটছে৷ তবে এরাই মূলত সবচেয়ে বেশি ছিনতাই, ডাকাতি কিংবা খুনের সাথে জড়িত বলে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।

এবার ‘১৩৮’ ব্যাপারটা একটু খোলাসা করা যাক,

ঢাকা ও এর পাশ্ববর্তী ১৩৮ টি ওয়ার্ডে নানা অপরাধ কর্মকান্ড চালানো ১৩৮ টি কিশোর গ্যাং। যা প্রথমে আলোচনায় আসে নাগরিক কমিটির নেতা মোল্লা মোহাম্মদ ফারুকী এহসানের একটি ফেসবুক পোস্টের সূত্র ধরে। সেখানে ফারুকী জানান,

” তারা শেখ হাসিনার সরকার পতনের জন্য ঢাকা ও  আশপাশের ১৩৮ টি ওয়ার্ডে সক্রিয় কিশোর গ্যাংদের নিয়ে  একটা কিশোর গ্যাং ফেডারেশন তৈরি করবেন। এ ধারণা আসে আরেক নেতা আরাফাত রহমান শৈশবের কাছ থেকে। তারপর তারা সারা ঢাকা শহর নিয়ন্ত্রণ করবেন।” জুলাইয়ে ধ্বংসাত্মক কাজে এই কিশোর গ্যাংগুলো শক্তি দেখিয়েছিলো বলেও জানান তিনি।

আরাফাত রহমান শৈশব তার এক পোস্টে দাবি করেন,

“জুলাই আগস্টে আন্দোলনে, শুধুমাত্র চানখারপুল এলাকাতেই পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপর ১৯২ রাউন্ড গুলি চালিয়েছে টিম ১৩৮।

এই কিশোর গ্যাং ফেডারেশন কতটা ভয়ংকর তা তাদের এই দুই নেতার মন্তব্য থেকেই আঁচ করা যায়। মোল্লা মোহাম্মদ ফারুকী এহসান সম্পর্কে জানা যায়, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী। তার বড় পরিচয় তিনি ছাত্র আন্দোলনের কথিত মাস্টারমাইন্ড খেতাবা পাওয়া মাহফুজ আলম এবং নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেনের সহপাঠী। এছাড়া শেখ হাসিনার সরকার পতনের লক্ষ্যে চানখারপুলের মেসে বসেই নানা ছক কষেন, কর্মসূচি গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করেন এ তারা। যা মোল্লা মোহাম্মদ ফারুকী এহসানের ফেসবুকে স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়।

আরাফাত রহমান শৈশব একসময় ছাত্রদল করলেও, জুলাই আগস্টের আন্দোলনে কিশোর গ্যাং নিয়ে মাঠে থেকে পরিচিতি লাভ করে বর্তমানে জাতীয় নাগরিক কমিটির সাথে যুক্ত রয়েছে৷

কিশোর গ্যাং ১৩৮ নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, তাদের সবচেয়ে বেশি সদস্য রয়েছে, রাজধানীর মোহাম্মদপুর, বসিলা, পুরান ঢাকা, মিরপুর, কেরানীগঞ্জ, যাত্রাবাড়ি, টঙ্গী, উত্তরা ও রামপুরা-বাড্ডা এলাকায়। সাম্প্রতিক ছিনতাইয়ের অধিকাংশ ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা যায় তা এসব এলাকাগুলোতে ঘটেছিলো। এমনই একটি কিশোর গ্যাং যারা মোহাম্মদপুরে সক্রিয় রয়েছে এবং ১৩৮ এর হয়ে কাজ করে। তার দলনেতার সাথে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। নাম, পরিচয় গোপন রাখার স্বার্থে তিনি কিছু ভয়ংকর তথ্য প্রদান করেন। তিনি জানান,

‘জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে তারা ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। পুলিশ ও সরকারদলীয় নেতা-কর্মীদের উপর সশস্ত্র হামলা, বিভিন্ন স্থাপনা ভাঙচুর সহ মাঠে থেকে তারা সরকারের পতন ঘটিয়েছে। তবে আন্দোলনের বহু পূর্ব থেকেই তাদের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন ছাত্র নেতার যোগাযোগ ছিলো। সেসব নেতা তাদের এলাকাগুলোতে এসে তাদের সাথে আড্ডা দিতো। বিভিন্ন সময় অনুষ্ঠান, পার্টি কিংবা হাত খরচের জন্য টাকা প্রদান করতো। জুলাই আগস্টে তার দল প্রায় ৫ লক্ষ টাকা পেয়েছিলো দুই নেতা থেকে। তার মতে, শুধুমাত্র তার দল নয় অন্য কিশোর গ্যাং গুলোও একই পরিমাণ বা কাজের ভিত্তিতে বেশি অর্থ পেয়েছে। সে দুই নেতার একজন মোল্লা ফারুক, অন্যজন আরাফাত রহমান শৈশব। তারা মজা করে আরাফাতকে জিন্দাপীর বলেও ডাকেন বলে জানান এই কিশোর গ্যাং নেতা৷ এ দুজনকেই তারা মূলত নেতা হিসেবে গণ্য করেন৷ তবে এর বাইরেও কয়েকজন তাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা এবং আন্দোলনের সময় নির্দেশনা দিতো বলে জানান এ কিশোর গ্যাং নেতা।’

আরো যেসব নেতা কিশোর গ্যাং ১৩৮ এর সাথে সংযুক্ত ছিলো তাদের তথ্যও এসেছে ‘ট্রু গেজেটে’র হাতে। এর মধ্যে অন্যতম বর্তমানে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিডিয়া সেলের সম্পাদক, আল মাসনূন। এক ফেসবুক পোস্টে তিনি বলেন, ” বাংলাদেশটা চালাই মূলত আমরা ১৩৮।” এর মাধ্যমে তিনি কিশোর গ্যাং ১৩৮ এর মাধ্যমে তাদের ক্ষমতা দেশব্যাপী বিস্তৃত এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন।

এছাড়া নাম উঠে এসেছে সাবেক শিবির নেতা, বর্তমানে নাগরিক কমিটির অন্যতম নেতা মোহাম্মদ হিজবুল্লাহ ওরফে আরেফিন। আন্দোলনে কিশোর গ্যাংগুলোকে ধ্বংসাত্মক কাজের পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়ন করাতেন তিনি এমনটাই অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।

সাম্প্রতিক ছিনতাই, ডাকাতি এবং দেশজুড়ে ধর্ষণের ঘটনায় যখন তোলপাড় চলছে, তখন আবারো আলোচনায় এসেছে কিশোর গ্যাং ১৩৮। জার্মানী অবস্থান করা এক্টিভিস্ট এবং ব্লগার বাঁধন মুন্সি তার এক ফেসবুক পোস্টে বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতির জন্য কিশোর গ্যাং ১৩৮ কে দায়ী করেন। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আরো অসংখ্য ব্যক্তি এ বিষয়ে সমালোচনায় মুৃখর। এর জবাবে, কিশোর গ্যাং ফেডারেশন ১৩৮ এর নেতা আরাফাত রহমান শৈশব তার এক ফেসবুকে লিখেন,

” ১৩৮ রে যদি আপনারা এতো সিরিয়াসলি নেন, তাইলে ১৩৮ এর সাথে বসেন। আন্দোলন কী আপনারা একা করেছেন নাকি?”

অন্য এক পোস্টে তিনি দাবি করেন,

” কিশোর গ্যাঙ সমূহ থেকে দূরে থাকার জন্য আমি আমার হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার বদলাইছি মাস তিনেক আগে। এখন আমি শান্তিতে আছি আলহামদুলিল্লাহ। “

তার এই ফেসবুক পোস্ট থেকে স্পষ্ট হয় তিনি কিশোর গ্যাং গুলোর নেতৃত্বে ছিলেন। বর্তমানে তাদের সাথে সংযুক্ত নয় দাবি করলেও ভিন্নমত পোষণ করেন মিরপুরের ১৩৮ গ্যাংয়ের এক সদস্য। এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে তিনি জানান,

” সরকার পতনে সফল ভূমিকা রাখার পর আমাদের সবাই বাহবা দিয়েছে। পুরষ্কৃত করেছে। আমাদের শুভ্র এবং আরাফাতের সাথে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ হয়। আওয়ামী লীগের কর্মসূচি ঠেকানো এবং লীগের নেতা-কর্মীদের ধরিয়ে দিতে আমরা তাদের সহযোগিতা করছি প্রতিনিয়ত।”

ছিনতাই নিয়ে প্রশ্ন করার পর, এ কিশোর গ্যাং সদস্য এ বিষয়ে বলতে অপরাগতা জানিয়েছে। তাকে অপারেশন ডেভিল হান্টের কথা স্মরণ করিয়ে দিলে সে হাসতে হাসতে জবাব দেয়,

” এসব তো হইলো গিয়া লীগ হান্ট কর্মসূচি। আমগোরে কিছু করার ক্ষমতা পুলিশের নাই। তাগো বসরাই আমগো শেল্টার দেয়। “

সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের জন্য সংগঠিত করা কিশোর গ্যাং ১৩৮ ঢাকায় অধিকাংশ ছিনতাই, ডাকাতি এবং খুনের ঘটনায় জড়িত। রহস্যজনক কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের বিরুদ্ধে কোনো একশনে যাচ্ছে না। এর ফলে জনজীবনের নিরাপত্তা চরম হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। জুলাই আগস্টে এই কিশোর গ্যাংগুলো USAID এর পক্ষ থেকে পাওয়া অর্থ জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতা, ফারুকী, শৈশব বা অন্যদের থেকে পেলেও বর্তমানে অর্থ সংস্থান এবং নেশার টাকা জোগাতে তারা ভয়ঙকর ছিনতাই, ডাকাতির সাথে জড়িয়ে পড়েছে। তাদের থামানোর যেন কেউ নেই। রাজধানীর নিরাপত্তা যখন চরম হুমকির মুখে, তখন কিশোর গ্যাং ১৩৮ ও অন্যান্য অপরাধী চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছে সুশীল সমাজ এবং সাধারণ ভুক্তভোগী নাগরিকগণ।

Share This Article
সংবাদকর্মী
error: Content is protected !!